ঢাকেশ্বরী থেকে ঢাকা !
নিজস্ব প্রতিবেদক
রাজধানী ঢাকার বয়স ধারণা করা হয় ৪০০ বছরের কাছাকাছি। এই ৪০০ বছরের শহর অনেক ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে , ঢাকেশ্বরী থেকে ঢাকা হয়েছে। আবার কেউ কেউ মনে করেন ঢাকা শব্দটি ১৯৮২ সালের পূর্বে ঢাক্কা নামে লেখা হত।
ঢাকার নামকরণের সঠিক ইতিহাস নিয়ে ব্যাপক মতভেদ রয়েছে। সেন বংশের রাজা বল্লাল সেন বুড়িগঙ্গা নদীর তীরবর্তী এলাকায় ভ্রমণকালে সন্নিহিত জঙ্গলে হিন্দু দেবী দুর্গার একটি বিগ্রহ খুঁজে পান। দেবী দুর্গার প্রতি শ্রদ্ধাস্বরূপ রাজা বল্লাল সেন ঐ এলাকায় একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। যেহেতু দেবীর বিগ্রহ ‘ঢাকা’ বা গুপ্ত অবস্থায় খুঁজে পাওযা গিয়েছিল, তাই রাজা মন্দিরের নাম রাখেন ঢাকেশ্বরী মন্দির। মন্দিরের নাম থেকেই কালক্রমে স্থানটির নাম ঢাকা হিসেবে গড়ে ওঠে।
মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর যখন ঢাকাকে সুবা বাংলার রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেন। তখন সুবাদার ইসলাম খান আনন্দের বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ শহরে ‘ঢাক’ বাজানোর নির্দেশ দেন। এই ঢাক বাজানোর কাহিনী লোকমুখে কিংবদন্তির রূপ নেয় এবং তা থেকেই শহরের নাম ঢাকা হিসেবে গড়ে ওঠে।
ধারণা করা হয় কালের পরিক্রমায় ঢাকা প্রথমে সমতট, পরে বঙ্গ ও গৌড় প্রভৃতি রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। খ্রিস্টীয় ১৩শ শতাব্দীর শেষের দিকে মুসলমানেরা ঢাকা অধিকার করে। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের ফরমান ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকাকে সুবে বাংলার রাজধানী ঘোষণা করা হয় । সম্রাট জাহাঙ্গীর-এর নাম অনুসারে রাজধানীর নাম জাহাঙ্গীরনগর রাখা হয় ।
এর আগে সম্রাট আকবরের আমলে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার প্রাদেশিক রাজধানী ছিলো বিহারের রাজমহল। সুবা বাংলায় তখন চলছিলো মুঘলবিরোধী স্বাধীন বারো ভূইঁয়াদের রাজত্ব। বারো ভূইয়ার নিয়ন্ত্রণ থেকে বাংলাকে উদ্ধার করতে ১৫৭৬ থেকে ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বারবার চেষ্টা চালানো হয়। সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে ইসলাম খান চিশতীকে রাজমহলের সুবেদার নিযুক্ত করেন। তিনি ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনা করে রাজধানী রাজমহল থেকে সরিয়ে ঢাকায় স্থানান্তর করেন। সুবেদার ইসলাম খান চিশতী দায়িত্ব নেবার মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে বারো ভূইয়ার পতন ঘটে।
১৬১০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা সুবা বাংলার রাজধানী ঘোষনা করা হলেও সুবা বাংলার রাজধানী বারবার পরিবর্তন করা হয়েছে। ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দে সুবেদার শাহ সুজা রাজধানী আবার রাজমহলে স্থানান্তর করেছিলেন। শাহ সুজা’র পতনের পর ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে সুবেদার মীর জুমলা আবার রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তর করেন। এরপর বেশ কিছুকাল ঢাকা নির্বিঘ্নে রাজধানীর মর্যাদা ভোগ করার পর ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে সুবেদার মুর্শিদ কুলী খান রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করেন। এরপর ঢাকায় মুঘল শাসনামলে চলতো নায়েবে নাজিমদের শাসন। ব্রিটিশ শাসনের আগে পর্যন্ত এভাবেই চলছিলো। ব্রিটিশরা রাজধানী হিসেবে কলকাতাকে নির্বাচিত করলে ঢাকার গুরুত্ব আবারও কমতে থাকে। এরপর দীর্ঘকাল পর ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা আবার তার গুরুত্ব ফিরে পায়। বঙ্গভঙ্গের পর ১৯০৫ সালে ঢাকাকে আসাম ও বাংলার রাজধানী করা হয়। কংগ্রেসের বাঁধার মুখে ব্রিটিশ রাজ আবার ১৯১১ সালে রাজধানী কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের পর ঢাকা নবগঠিত পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের রাজধানী হয়। তবে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ প্রত্যাহৃত হলে ঢাকা তার প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদাটি হারায়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর ঢাকা পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনিক রাজধানীতে পরিণত হয়। পরে ১৯৭১ সালে ঢাকা স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাজধানী ঘোষিত হয়।
সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মোগল সাম্রাজ্যে দুর্বলতা দেখা দেয়ার সময়ে আঠারো শতকের শুরুতে ঢাকা থেকে রাজধানী সরিয়ে নেয়া হয় মুর্শিদাবাদে। মুঘল পরবর্তীযুগে ঢাকা প্রায় ১৯০ বছর ব্রিটিশ শাসনাধীন থাকে। পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালে ঢাকা পূর্ব বঙ্গের রাজধানী হিসেবে পাকিস্তানের অন্তর্গত হয়। ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ ঢাকাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয়। ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুযায়ী ঢাকাকে গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাজধানী হিসেবে ঘোষনা করা হয়।
প্রতিক্ষণ/এডি/এমএস