তারে-বেতারে ঘুরে বেড়ায় অপরাধীর প্রেতাত্মা!
গতি আর প্রগতির মাঝেই আমাদের নিয়তি, বাস। প্রগতির ফাল্গুধারা গতিহীন বর্বর সমাজকে দিয়েছে গতিশীল সভ্য সমাজের আস্বাদ।বিস্বাদ যদিও কম নয়।তারপরও গতি স্বর্বস্ব জীবনই আমাদের আরাধ্য। গতিময়তার দোলা আমাদের এতো বেশি আন্দোলিত করেছে যে, আমরা খেঁই হারিয়েছি। মাতাল হয়ে গেছি। হারিয়ে ফেলেছি নির্মল অনুভূতি। ক্রমেই ভোগের আর ভাগের মোহ আমাদের পেয়ে বসেছে।
একদা যে জীবন ছিলো গুহায়, সে জীবন এখন অট্টালিকায়। পশু শিকারের জন্য অস্ত্রে শান দেয়াতে ব্যতিব্যস্ত ছিলো যে হাত; সে হাত এখন রিমোট কন্ট্রোলে। পাথরের ঘর্ষণে আগুন ধরাতে যে হাত ছিলো সিদ্ধহস্ত; সে হাত এখন কী-বোর্ডে, মোবাইলের টাচ স্ক্রিনে। যে রণ কৌশল ছিলো ভয়নাক জন্তু-জানোয়ার ঠেকাতে, সে কৌশল খাটে ‘মা বোমা’আর ‘বাবা বোমার’বিধ্বংসী বাহাদুরিতে। যে মন সজীব হতো সবুজ বুনো জীবনের আনন্দে, সে মন এখন উদ্বেলিত হয়, বিভ্রান্ত হয় চাপাতি চালানো রক্ত জবার রঙে।
সত্যিই কি এগিয়েছে জীবন; এগিয়েছে সভ্যতা? এই কি জীবনের নিয়তি?
চোখের নিমিষে সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দেয়ার যে কৌশল, গতিশীল যে উড়াল যান; তার কিছুই হতো না যদি প্রগতিকে অস্বীকার করা হতো। প্রগতি আমাদের গতি দিলেও নষ্ট করেছে স্বাভাবিক অনুভূতি। মাকড়সার জালের মতো তরঙ্গ বিস্তৃত জালে আমরা আটকে পড়েছি। সেকারণেই দৈনন্দিন জীবনের বহমান দু:খ, কষ্ট, ক্লেদ, জীর্ণতা, যৌনতা, আনন্দ, বিষাদ আর বেদনা প্রকাশে তরঙ্গই যেন হয়ে উঠেছে প্রধান মাধ্যম।
একদিকে প্রযুক্তির নিরন্তর বিকাশ, অন্যদিকে সমাজ-সংসারে জটিলতায় নাভি:শ্বাস। পরিণতি ক্রমশ ‘বিচ্ছিন্নতা’। বিচ্ছিন্ন হতে হতে একেকটি মন এখন দূরের একেকটি দ্বীপ। সেই দ্বীপেও তরঙ্গ মাধ্যম সংযোগ ঘটায়, আলো জ্বলে। আশার প্রতিফলন ঘটে, মনের-মতের বিচ্ছুরণ ঘটে। মাধ্যম যেহেতু তরঙ্গ সুতরাং শারিরীক উপস্থিতি সেখানে নিষ্প্রয়োজন। তরঙ্গে ভর করে মতের-পথের মতানৈক্য চলে কথিত সেই ভার্চুয়াল জগতে। জীবনের বাস্তব রং ফিকে হয়ে আসে, সব রং হার মানে জুকারবার্গের নীল দেয়ালের কাছে। আর সেই নীল দেয়ালময় জীবনই হয়ে উঠে এ শতাব্দীর অন্যতম আকর্ষণ।
সে জীবনের স্বাভাবিক অনুভূতি, প্রেম, ভালবাসা, দু:খ, রাগ, আনন্দ সবই প্রকাশ পায় প্রতিকী চিহ্নে। স্বাদ-বিস্বাদের কোনো রকমফের নেই, সবই এক। তারপরও অদ্ভূত মোহাচ্ছন্নতা আছে। সেই মোহ থেকে দ্রোহ, বিপ্লব, ঘৃণা, বাদ, প্রতিবাদ, ভোগ, সম্ভোগ, ভাব, কু-ভাব সব কিছুরই প্রতিফলন ঘটে ঐ ভার্চুয়াল জগতে। তবে বিছিন্নতা নামক অক্টোপাসের করাল থাবায় আষ্টেপৃষ্ঠে থাকে সে জীবন। এরপরও ফেরানো যায় না। শুধু কি তাই, সেই নীলাভ দেয়াল থেকে দিন কয়েকের জন্য বিচ্ছিন্ন থাকার কষ্টও হয় কারো কারো। কী ভালোলাগা আছে সে জীবনে! হয়তো আছে। তবে উৎকন্ঠা এবং ভয়ের কারণও রয়েছে। কেননা অপরাধীর প্রেতাত্মারা সেখানেও নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়ায়। তারে-বেতারে ঘৃণা বিদ্বেষ ছড়ায়। জীবনের স্বাভাবিকতাকে অদৃশ্য নখের আঁচড়ে ছিন্ন ভিন্ন করে, রক্তাক্ত করে। দুর্ঘটনায় পতিত যানের মতোই দুমড়ে-মুচড়ে দেয় সবকিছু।
এবার সাংবাদিকতার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে সেই হতভাগ্য জীবনগুলোর খন্ডিত কিছু চিত্র তুলে ধরা যাক:
কেসস্টাডি-১: দিন তারিখ মনে নেই। পেশাগত প্রয়োজনে সেদিন রাতের ডিউটি ছিলো। ব্যস্ত এ শহরে রাতে সবাই ঘুমিয়ে থাকে; শুধু কিছু রাতজাগা পাখি, অপরাধী, পুলিশ আর অনুসন্ধানী কিছু সাংবাদিক জেগে থাকে খবরের খোঁজে। চায়ের কাপে ঝড় তুলে পলাশীর মোড়ের আড্ডাটা সবে জমতে শুরু করেছে। হঠাৎ মুঠোফোনে খবর আসে; মীরপুরে চাপাতির কোপে একজনের প্রাণ গেছে। টিভি স্ক্রল দিয়েই সবাই ছোটে সেদিকে। গিয়ে দেখা যায় ঘটনাস্থলে পুলিশের গাড়ি, লোকে লোকারণ্য। বাধা ডিঙিয়ে একটি বাড়ির গেটের সামনে চোখ পড়ে; নিথর দেহটি উপুড় হয়ে পড়ে আছে। তার রক্তের স্রোতে ভেসে গেছে পথ। নিজ বাড়ির গেটেই চাপাতি দিয়ে তার ঘাড়ে মাথায় এলোপাথারি কুপিয়েছে দুবৃত্তরা। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ভাচুর্য়াল জগতের একজন সৈনিক ছিলো সে। নিয়মিত নিজের স্বাধীন মত প্রকাশ করতো। মতের বিরুদ্ধবাদীরা তাকে টার্গেট করে। ভার্চুয়াল জগতে সেঁটে দেয়া ছবি, স্ট্যাটাস, ঘন্টায় ঘন্টায় চেক-ইনসহ যাবতীয় আপডেট দেখে তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হয়। অবশেষে রাতের নির্জনতায় বাড়ির গেটে ঢুকার পূর্বমুহূর্তেই কেড়ে নেয় তার প্রাণ। এ ঘটনায় পরবর্তীতে ধরা পড়েছে কয়েকজন। বিচারে ফাঁসি-যাবজ্জীবনও হয়েছে। কিন্তু যে জীবন চলে গেছে, তাতো আর ফিরে পাওয়া যায়নি। প্রেত্মাতার ভয়ানক থাবায় বাস্তব আর ভার্চুয়াল জগত সবকিছুর উর্দ্ধে চলে গেছে সে। একটি ভার্চুয়াল দ্বন্দ্ব আর সংঘাত কতটা রোমহর্ষক বাস্তব রূপ ধারণ করতে পারে; এটি তারই এক নির্মম চিত্র ।
কেসস্টাডি-২: তিশা (ছদ্ম নাম)। পেশায় স্কুল শিক্ষিকা। কর্মব্যস্ত দিন শেষে বাসায় ফেরে। একমাত্র কন্যা ছাড়া তার আর কেউ নেই। তার সাথে গল্প করে, মুঠোফি তুলে, গেমস খেলে সময় কাটায়। অত:পর মা-মেয়ের একান্তে কাটানো সময়ের কিছু ছবি জুকারবার্গের নীল দেয়ালে সেঁটে দেয়। মুহূর্তেই পরিচিত-অপরিচিতরা ভালোবাসা, উচ্ছ্বাস আর প্রশংসার বন্যায় ভাসিয়ে দেয়। দিনে দিনে তিশার আগ্রহ বাড়ে। স্কুলে যাওয়ার পথে আরো দুয়েকটি সেলফি তোলে। যতই এই ভার্চুয়াল জগত থেকে সে দূরে থাকতে চায়, ততই সে জগৎ যেন আরও হাতছানি দেয়। সুতরাং একের পর এক ছবি, ব্যক্তিগত তথ্য জুকার সাহেবের তথ্য ভান্ডারে জমা রাখতে শুরু করে। একদিন হঠাৎ চ্যাটিং বক্সে এক লোকের প্রশংসাসূচক বাক্য এবং কবিতা আসে। সাথে আরো কত কী। দিন যায়, খোশগল্প বাড়ে। ভার্চুয়াল জগতের দোলন যেন আপনের চেয়েও আপন হয়ে ওঠে। তারা প্রায় দেখা করতে শুরু করে। প্লেটের মচমচে ফুচকা পর্ব শেষে কফি সন্ধ্যা জমে উঠে। একদিন বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হবার অঙ্গীকারও করে ফেলে। চ্যাটিং বক্সে সর্বশেষ উঠানো ছবির বিনিময় চলে। এরপর বেশ কিছুদিন যোগাযোগ নেই।
হঠাৎ এক সকালে জুকারবার্গের মোহনীয় দেয়ালে নিজের এবং তার মেয়ের নগ্ন ছবি আবিষ্কার করে তিশা। ছবিটি তাকে ইনবক্সে যে পাঠিয়েছে, সে আর কেউ নয়; তার ভার্চুয়াল প্রেমের সেই রহস্য মানব দোলন। দোলনের মতো একজন মানুষ কীভাবে এই কাজ করতে পারলো; ভেবে পায় না তিশা। এরপর দোলনের মোবাইল থেকে আসে একটি এসএমএস। তাতে লেখা- এরকম এডিট করা আরো ছবি আছে; আপাতত ১০ হাজার টাকা দাও, বাকীটা পরে নেবো। ভয়ে-অপমানে কান্নায় ভেঙে পড়ে তিশা। নীল দেয়ালের বন্ধু তালিকা থেকে ছেঁটে ফেলা হয় ঐ ভার্চুয়াল প্রেমিককে। কিন্তু মুঠোফোনে, না সেটা সম্ভব নয়। দোলন তাকে আবারো কফি সন্ধ্যার আমন্ত্রণ জানায়, আর ১০ হাজার টাকা বিকাশে পাঠাতে যেন ভুল না হয় সেটা স্মরণ করিয়ে দেয়। টাকা না দিলে ভার্চুয়াল সমাজের প্রতিটি মানুষের কাছে বিকৃত ছবি পৌঁছে দেয়ার হুমকি দেয়। তিশা স্কুলের মাইনে থেকে অনেক কষ্টে টাকা পাঠায়। সপ্তাহ খানেক পর আবার পাঠায়। এভাবে তিন মাসে ৭০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় দোলন। তিশার দেনা বেড়েছে, আর সাধ্য নেই। একদিকে লোকলজ্জার ভয়, অন্যদিকে সর্বশান্ত হওয়া, কী করবে সে? বহু ভেবে চিন্তে একটি টেলিভিশন চ্যানেলের ক্রাইম রিপোর্টারের সাথে যোগাযোগ করে। এরপর ভিকটিমকে নিয়ে প্রথমে দোলনের বিরুদ্ধে থানায় একটি জিডি করা হয়। জিডির কপি ডিএমপির সাইবার ক্রাইম ইউনিটে দেয়া হয়। এরপর ভার্চুয়াল প্রতারকটির লোকেশন ট্রেক করার চেষ্টা চলে। বন্ধ করে দেয়া হয় প্রতারক দোলনের ফেসবুক আইডি। ঐ বিকৃত মানসিকতার লোকটির সাথে ফোনে যোগাযোগ করে তার সব কথা রেকর্ড করা হয়। ফোনে সে জানায়-‘আমি যার কাছ থেকে ইচ্ছা টাকা নেব, আপনার কি?ঐ মেয়ে কত খারাপ, আপনি জানেন না’। প্রতারণার এ ঘটনা নিয়ে টেলিভিশনে রিপোর্টটি অনএয়ার হবার পর পুলিশ দোলনকে খুঁজতে তৎপর হয়ে উঠে। আপাতত তিশা নিরাপদ। কিছুদিন হয়তো ভার্চুয়ালের মোহ থেকে দূরে থাকবে। হয়তো সর্তকও থাকবে।
কেসস্টাডি-৩: জ্যোতি(ছদ্মনাম)।একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় সেমিস্টারে পড়ে। ব্যস্ত বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। তার অবসরের সঙ্গী আইফোন। এই ফোনেই মিউজিক শোনে, গেমস খেলে, ছবি তোলে, ভিডিও করে, লাইভ চ্যাট করে, সেলফির নানা রঙে নানা ঢঙে নিজেকে রঙিন করে সাজিয়ে তোলে। বাস্তবে তেমন কোনো বন্ধু নেই তার। তাতে কী! ভার্চুয়াল জগতে নিজের শত শত বন্ধু আর অনুসারীতো আছে! এদের মধ্যে মামুন সরকার যেন একটু বেশিই এগিয়ে। মাত্র দুমাসের পরিচয় হলেও মামুনের কাছে রীতিমতো আরাধনার পাত্রী সে। ভার্চুয়াল রাজপুত্র মামুনের সাথে বাস্তবে দেখা করার জন্য অস্থির হয়ে পড়ে জ্যোতি। স্বপ্নীল সে ক্ষণ ঘনিয়ে আসে। মেরুন রঙের একটি প্রিমিউ গাড়ীতে চড়ে জ্যোতির ক্যাম্পাসে আসে সেই কাঙ্খিত ভার্চুয়াল প্রেমিক। তারপর থেকে জ্যোতি প্রায়ই লং ড্রাইভে যায় ওর সাথে। কখনও মীরপুরের বেঁড়িবাধে, কখনও পূর্বাচলের কাশবনেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। একেক দিন একেক মডেলের গাড়ি ড্রাইভ করে আসে মামুন। জমে উঠে প্রেম। দুজনের ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের কিছু ছবি তুলে রাখে মামুন। কয়েক মাস না যেতেই আসল চেহারা বেরিয়ে আসে ভার্চুয়াল রাজপুত্রের। তার মাঝে হঠাৎ যেন প্রেতাত্মা এসে ভর করে। ফলে জ্যোতিকে ফোন করে জানায়,‘আমার ৫০ হাজার টাকা লাগবে, খুব বিপদে আছি। কিছু ধার দাও’। কিছুদিন পর ৭০ হাজার, ১ লাখ; তারপর ২ লাখ। শোধতো দূরের কথা টাকার অংক বাড়তেই থাকে। এবার জ্যোতি টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তখন মামুন অন্ত:রঙ্গ মুহূর্তের কিছু ছবি ফেসবুকে ছেড়ে দেয়ার হুমকি দেয়। এবার জ্যেতির সন্দেহ ঘনীভূত হয়। সে মামুনকে কিছু না বলে তার উত্তরার বাড়িতে গিয়ে জানতে পারে সিনেমাটিক সব তথ্য। মামুন বাড়ির মালিকের ছেলে নয়; তার গ্যারেজের মিস্ত্রি। বাড়ির ভেতরের রুমে নয়; সিঁড়ির পাশের রুমে অন্য কর্মচারীদের সাথে থাকে সে। সেদিকে যেতেই মামুন তাকে দেখে পালিয়ে যায়।
কর্চারীরা জানায়, মাস্টার্স নয় সে এইচএসসি পর্যন্ত পড়েছে। ভারাক্রান্ত মনে বাসায় ফিরে আসে জ্যোতি। এসে ফেসবুক খুলতেই দেখে মামুনের সাথে অন্তরঙ্গ ছবি। সেখানে জ্যোতিকে নিয়ে অশালীন মন্তব্যও করেছে অনেকে। এ ব্যাপারে জানার জন্য জ্যোতি মামুনকে ফোন দিতেই উল্টা ধমক, ‘আমাকে বিয়ে করবি, না হয় বাকী সব ছবি দিয়ে দেব’। মেয়েটির বাবা-মায়ের ফোনেও হুমকি আসে। এতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে পরিবারটি। বাধ্য হয়ে থানায় জিডি করতে যায় জ্যোতির পরিবার। কিন্তু পেশাদার অপরাধী মামুন থানা-পুলিশকে আগেই ম্যানেজ করে রেখেছে, সুতরাং জিডি নেয়া হয় না। অবশেষে রিপোর্টারের শরণাপন্ন হলে তাদের সাথে নিয়ে থানায় যাওয়া হয়। এবার পুলিশ জিডি নেয়। এরপর ঐ প্রতারকের সাথে ফোনে কথা বলতে গিয়ে কথোপকথন রেকর্ড করা হয় ক্যামেরায়। সে বলে‘ঐ মেয়ে আমার গাড়ি দেখে প্রেমে পড়েছে। সে একটা লোভী। তাই আমার টোপে পড়েছে। এখন বাড়ি-গাড়ি কিছুই নেই দেখে চলে যেতে চায়। আমি ছাড়বো না তাকে।’তার এ ধরনের স্বীকারোক্তিসহ রিপোর্টটি অনএয়ার যায় টেলিভিশনে। এরপর পুলিশ ঐ ভাচুর্য়াল অপরাধীকে ধরতে তৎপর হয়ে উঠে। এবার তার মোবাইল থেকে আর কল আসে না জ্যোতির নম্বরে। কারণ এটি বন্ধ করেই সে গা ঢাকা দিয়েছে। কিন্তু কতদিন? হয়তো ধরা পড়বে, অথবা পার পেয়ে যাবে। তারপর হয়তো অন্য কোন জ্যোতিকে শিকার বানাবে। তার মধ্যে যে প্রেতাত্মা ভর করেছে, তা থেকে ভার্চুয়াল জগতের আরো কত জ্যোতি ভিকটিম হবে কে জানে?
কেস স্টাডি ৪: চাঁপাইনবাবগঞ্জের বারঘরিয়ার শরীফা তুরজাউন। না, এটা ছদ্ম নাম নয়, আসল নাম। কারণ সে শিকার নয়, শিকারী। তার শিকারে একে একে পরিণত হয়েছে ২৪ জন পুরুষ। চমকপ্রদ সে ঘটনা।
হঠাৎ একদিন কারওয়ানবাজারে অফিসের নিচে এসে ফোন দিলো কয়েকজন ভুক্তভোগী। আটটি বিয়ের কাবিন হাতে দিয়ে বলল ‘বাকী ১৬ টি বিয়ের কাবিন রাজশাহী ও চাঁপানবাবগঞ্জে আছে। এই মেয়ের অত্যাচারে আমরা অতীষ্ট; আমাদেরকে বাঁচান। তার হাত অনেক লম্বা; থানা, পুলিশ, কোর্ট এমনকি বিয়ের কাজী পর্যন্ত তার হাতে। আমাদের অধিকাংশের সাথে ফেসবুকে পরিচয়, ঘনিষ্ঠতা। এরপর বিয়ের নাম করে ভুয়া কাবিন দেখিয়ে কোর্টে মামলা দিয়ে সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছে সে। তার রূপে পাগল হয়ে এখন খেসারত দিচ্ছি’।
শরীফার ২৩তম স্বামীর ভাই ফরহাদ। একটি পেন ড্রাইভ হাতে দিয়ে বললো ‘এতে কিছু ডকুমেন্ট আছে, দেখলে বুঝতে পারবেন কতটা ভয়ংকর নারী সে। ফেসবুকে-আমার সৌদি প্রবাসী ভাইয়ের সাথে পরিচয়, পরে বিয়ে। কিন্তু বিয়ের পর সে ভাইয়ের রাজশাহীর দুতলা বাড়িটি লিখে নেয় এবং নগদ ৫০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। এরপর তার বাপের বাড়ি চলে যায়। এখন আর ফোনও ধরে না। তাদের বাড়ি গেলে তাড়িয়ে দেয়, দেখা করে না।’
২৪তম বিয়ের কাবিনটি হাতে দিয়ে আরেক ভিকটিম রাজা বাবু বলে, ‘এখন ফেসবুকের মাধ্যমে চট্টগ্রামের এই ছেলেটিকে ফাঁদে ফেলেছে। তাকে নিয়ে ঢাকায় ২ মাসের অস্থায়ী সংসার পেতেছে। কিছুদিন পর ঐ ছেলেটির সব লুটে নিয়ে নারী নির্যাতনের মামলা দিয়ে মাসে মাসে তার কাছ থেকেও টাকা আদায় করবে শরীফা। তার মা, ভাই এবং দুজন দালাল তাদের এই কাজের সহযোগী। দালালদের একজন হুজুরের ছদ্মবেশ নিয়ে তাদের সাথে একই বাড়িতে থাকে। এটাই তাদের পেশা’। ইন্টারেস্টিং গল্প- শুনে বেশ থ্রিল অনুভব করছিলাম, কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছিল না। আদৌ রিপোর্ট করা যাবে কিনা ভাবছি! ঐ মুহূর্তে আরেকজন প্রতারিত স্বামী শীষ মোহাম্মদ বলল- ‘ভাই ওরাতো একদিনের জন্য হলেও ঐ মেয়ের সাথে সংসার করেছে। আর আমি, বিয়ে না করেই ফেঁসে গেছি। দেশে বউ-বাচ্চা আছে, আমি গ্রিসে থাকতাম। শরিফার সাথে ফেসবুকে পরিচয়, বন্ধুত্ব। এরপর ফোনে সখ্যতা। দেশে ফেরার পর একদিন রাতে তার বাসায় দাওয়াত করলো। দুজনে গল্প করছিলাম। হঠাৎ তার ভাইসহ দুজন এসে আমাকে মারধর করে বেহুঁশ করে ফেলে। নগদ টাকা, মোবাইল, পাসপোর্ট সব কেড়ে নিয়ে আমাকে রাস্তায় ফেলে রাখে। সুস্থ হয়ে ওদের বিরুদ্ধে মামলা করি। কিন্তু কোনো কাজ হয় না’।
‘ভিসার মেয়াদ শেষ পর্যায়ে, গ্রিসে ফিরতে হবে। বহু দেনদরবার করে নগদ ২ লাখ টাকা দিয়ে পাসপোর্ট ফেরত পাই। এরপর গ্রিসে চলে যাই। মাসখানেক পর ভুয়া বিয়ের কাবিন দেখিয়ে আমার ও পরিবারের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের মামলা করে শরীফা। সকাল-বিকাল বাড়িতে পুলিশ আসে’। ভাইয়েরা ফোন দিয়ে বলে-‘দেশে আইসা এসব সামাল দাও, তোমার কারণে আমরা ঘর ছাড়া’। তিনমাসের মাথায় দেশে ফিরে আসি। এসে দেখি ‘বউ বাচ্চা নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেছে। ফেসবুকে শরীফার পাল্লায় পড়ে আমার সংসারটাই এখন ভেঙে গেলো। এরপর তার বিরুদ্ধে থানায় মামলা করতে গেলেও পুলিশ মামলা নেয়না। বাধ্য হয়ে কোর্টে মামলা করি। মামলা চালাতে গিয়ে গ্রিসেও আর যেতে পারিনি; সংসারটাও গেল ’।
শীষ মোহাম্মদ কী সত্যি বলছে? তার চোখের দিকে তাকালাম, দেখি দুচোখ বেয়ে টপ টপ করে পানি ঝরছে।
প্রতারিত স্বামীদের চতুর্থজন চলচ্চিত্রের পার্শ্ব নায়ক। সে জানায়-‘বিয়ে যে তার কাছে একটি খেলা আগে বুঝিনি। এখন মামলার ভয় দেখিয়ে প্রতিমাসে আমার কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।’
শরীফার প্রতারিত স্বামীদের কাছ থেকে ৮ টি বিয়ের কাবিননামা, কিছু ছবি, পাতানো বিয়ের ভিডিও ক্লিপস, টাকা লেনদেনের চেক, মোবাইলের রেকর্ডসহ বেশকিছু প্রামাণ্য দলিল হাতে আসার পর আর কোনো সন্দেহ থাকল না। রিপোর্টটি করার জন্য রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের পথে রওনা হলাম।
প্রতিক্ষণের পাঠকদের জন্য সেই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের ভিডিও লিংক দেয়া হলো—–
https://www.youtube.com/watch?v=hP_Ufcmiox4
উপরের কেসস্টাডিগুলোর যে বাস্তব চিত্র তা থেকে অনুমেয় ভার্চুয়াল জগতে ধুম্রজাল সৃষ্টির মাধ্যমে নানা সম্পর্কের সমীকরনে কীভাবে-কতভাবে প্রতারণার ফাঁদ পাতা হয়, আর সে ফাঁদে ধরা পড়ে একেকজনকে কতটা চড়া মূল্য দিতে হয়েছে। এসব নিয়ে কত প্রতিবেদন! এরপরও প্রতিনিয়তই মানুষ মোহাচ্ছন্ন হয়, ভার্চুয়াল আবেগে সিক্ত হয় এবং সেখানে ঘুরে বেড়ানো প্রেতাত্মার ফাঁদে পা দিয়ে কিছু বুঝে উঠার আগেই সর্বশান্ত হয়। তাদের ভার্চুয়াল সম্পর্কের খেসারত দিতে গিয়ে পার্থিব জীবনে নেমে আসে গাঢ় অন্ধকার। সেই অন্ধকারে নিজের সংসারও হারিয়ে যায় অনেকের। ভার্চুয়াল প্রেতাত্মার কালো ছায়া যেন কারো উপর ভর না করে সেজন্য আমাদের জানতে হবে কীভাবে তরঙ্গায়িত ভুল সম্পর্কগুলো এড়িয়ে যেতে হয়। অপরিচিত ভার্চুয়াল মানুষটিকে আপন মনে করার আগে সামাজিক অবস্থান, শিক্ষা, বাস্তবতা –এসব বিষয়গুলো বারবার ক্রসচেক করা প্রয়োজন। জুকারবার্গের নীল দেয়ালে নিজেকে সমর্পণ করার আগে, ইনস্টাগ্রাম-টুইটারে প্রশংসার বন্যায় ভেসে যাবার আগে; নিরাপত্তার স্বার্থে ঐসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা কতটুকু নিরাপদ আছি; সে বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। হ্যাঁ, প্রযুক্তিকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না, এটা বাস্তবসম্মতও নয়। তবে সতর্কতার সাথে অনভিপ্রেত বিষয়গুলোকে দূরে রেখে এর সুফল অবশ্যই আমরা পেতে পারি।
যে বাস্তব ঘটনাগুলো তুলে ধরা হলো অপরাধ বিজ্ঞানের ভাষায় এর প্রতিটিই হচ্ছে‘সাইবার ক্রাইম’। এর শিকার যেন আমাদের আর না হতে হয়।
রাকিব হাসান
সম্পাদক, প্রতিক্ষণ ডট কম
[email protected]
বি:দ্র: প্রতিক্ষণের যেকোনো লেখা অনুমতি ব্যতিত কোথাও প্রকাশ বা প্রচার করা যাবে না। এটি কপি রাইট আইনে দন্ডনীয় অপরাধ।