‘ নিউক্লিয় বোমা ’ বিস্ফোরণের ৭০ বছর আজ
ইমতিয়াজ হোসেন
অন্যসব সকালের মত সেদিনর সকালটিও এসেছিল নাগাসাকি শহরে। একদম পরিষ্কার আকাশ। হঠাৎ বিকট গর্জনে কেঁপে ওঠে পুরো নাগাসাকি শহর। সাদা ধোঁয়ায় ঢেকে দিয়েছিল পুরো শহরটি। এরপরের চিত্র ছিল বিভিষীকাময় যা বলে বা লেখে বোঝানোর ক্ষমতা হয়তো কোন সুনিপুণ লেখকেরও নেই।
একদল মানুষ ছুটছে একটু বেঁচে থাকার আশায়। বিষয়টা এমন ছিল যেন ডুবতে বসা মানুষ এক টুকরা খড়-কুটো ধরে বাঁচতে চায়। ছূটতে ছুটতেই হয়তো অনেকে দেখছেন পাশে একজন পড়ে আছে দু’পাই নেই, আরেকজনের শরীর থেকে খসে পড়ছে হাত, আর নিজের দিকে তাকিয়ে দেখেন শরীরের অর্ধেকের বেশি ঝলসে গেছে। এসব দেখে যেন ছোটার ক্ষমতাও তার হারিয়ে গেছে। হতবিহবল হয়ে তিনি বসে পড়েছেন। দুজন মানুষ তাকে তুলে নিয়ে দৌঁড়াচ্ছেন। এমন ভয়ঙ্কর দৃশ্য পৃথিবীর মানুষ এর আগে কখনও দেখেনি। সেই ভয়াল নাগাসাকির পারমানবিক বোমার বিস্ফোরণের আজ ৭০ বছর পূর্ণ হলো।
জাপানের জন্য এই ইতিহাস এক দুঃস্বপ্নের মতো। ইতিহাসের সেই বিধ্বংসী দানব “ফ্যাটম্যান” নামের নিউক্লিয় বোমা যার বিস্ফোরণের মর্মান্তিক ঘটনা আজও জাপানিদেরকে আতঙ্কিত করে।
বিশ্বের প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র পারমানবিক বোমা নিক্ষেপণের উদাহরণ হল জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকির বোমা হামলার ঘটনা। এই বিস্ফোরণের সাথে সাথেই এর রাসায়নিক বিকিরণ শুরু হয়ে গিয়েছিল। মুহূর্তেই নিরব ঘাতকের কাজ শুরু করে দিয়েছিল এই ঘাতক বোমা। জীবন্ত, কর্মরত ও চাঞ্চল্য পরিবেশ রুপ নেয় এক মর্মান্তিক হৃদয়বিদারক পরিবেশের। চলন্ত মানুষ নিমিষেই অস্থিভস্মে পরিণত হয়। এভাবেই চলতে থাকে ফ্যাটম্যানের দানবীয় গ্রাস। সেই জীবন্ত ঝলসানো মনব চিত্র হয়তো অনেক দিন তাদের চোখের ঘুম কেঁড়ে নিয়েছিল। কারও ঝলসানো চিত্র আজও দেখা যায়। তবে শেষ হয়ে যায়নি এর রাসায়নিক বিকিরণের তীব্রতা। নাগাসাকির জনগণ এখনও শিকার হচ্ছে ৭০ বছরের পুরানো রাসায়নিক দাবদাহের। বিকলাঙ্গতা, বন্ধাত্ত্ব, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীর বলয় হতে এখনও মুক্ত হতে পারছে না নাগাসাকি।
জাপানের পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা ও বিভিন্ন দেশের পরিবেশ বিষয়ক বিজ্ঞানীদের মতে, জাপানকে আরও বহু বছর এর ক্ষত বহন করে যেতে হবে। সেখানকার পরিবেশের বাস্তুসংস্থানকে সম্পূর্ণ রুপে ধ্বংস করে দিয়েছে এই রাসায়নিক বোমার প্রভাব। এমনকি জলবায়ুগত সমস্যারও সৃষ্টি হয়েছে।
জাপানের নাগাসাকিতে পারমানবিক বোমা হামলার ৭০ বছর উপলক্ষে আজ দেশটি শোকের সাথে দিনটিকে স্মরণ করছে। এই শোক প্রকাশের প্রথমেই শিশুদের দ্বারা নিহতদের উদ্দেশে উচ্চারিত হয় এক শোকাবহ বিবৃতির। এই অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের এম্বাসেডর ক্যারোলিন কেনেডি ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন ৭৫টি দেশের অন্যান্য ব্যাক্তিবর্গ।
অনুষ্ঠানে নাগাসাকির মেয়র এবং জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো এবে বিবৃতি প্রদান করেন। বিবৃতি প্রদানকালে নাগাসাকির মেয়র সুমিতেরু তানিগুচি বলেন, ‘দিনটি আজও তার চোখের সামনে ভাসে’। বোমার পরবর্তী প্রভাব সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, ‘এই বোমার বিস্তৃতি সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল যা এখনও আমাদেরকে কাঁদায়।’
৮৬ বছরের এই মেয়র বলেন কিভাবে তিনি ঐ বোমার দ্বারা গুরুতর আহত হন যার জন্য ভয়ংকর ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তার হাতের এবং পীঠের চামড়া। তার এই বিবৃতি প্রদানকালে সেখানে পিনপতন নিরাবতার সৃষ্টি হয়।
প্রধানমন্ত্রী শিনজো এবে বলেন, ‘পারমানবিক অস্ত্রমুক্ত বিশ্ব গড়ার জন্য আমরা অঙ্গিকারবদ্ধ থাকব’। যে সময়টিতে নাগাসাকির উপর বোমাটির বিস্ফোরণ হয় সেই সময়কে স্মরণ করে রাখতে নাগাসাকির জনগণ এক শান্তির বেল বাজিয়ে নিহতদের জন্য শোক ও প্রার্থনা জ্ঞাপন করে। বেলটি বাজার সাথে সাথেই নাগাসাকির জনগণ থেমে যায় আর মাথা নিচু করে ৭০ বছর আগের ঐ দিনটির কথা স্মরণ করে।
১৯৪৫ সালের ৯ আগস্ট জাপানের নাগাসাকিতে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পারমানবিক বোমা “ফ্যাট ম্যান” নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানের আত্মসমর্পণের আহ্বানে জাপান সাড়া না দেওয়ায় তাঁর নির্দেশেই ঠান্ডা মাথায় চালানো হয় নারকীয় এই হামলা। এর উদ্দেশ্যে ছিল দু`টি। এক হল জাপানিদের জব্দ করা, আরেক হল যুদ্ধ দ্রুত শেষ করতে জাপানকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা।
নাগাসাকির এই পারমাণবিক হামলাটা অবশ্য হিরোসিমা হামলার তিনদিন পরে নয়, পাঁচদিন পরে, মানে ১১ অগাস্ট হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আবহাওয়ার পূর্বাভাসে জানা গেল, ১০ অগাস্ট থেকে টানা পাঁচদিন আবহাওয়া খারাপ থাকবে। আর খারাপ আবহাওয়ায় তো জায়গামতো বোমাই ফেলা যাবে না। সুতরাং, বোমা হামলাও এগিয়ে আনা হলো দুইদিন, ৯ অগাস্ট।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাগাসাকিতে যে কিছু ছিলো না, তা না। জাপানের তখনকার সবচেয়ে বড়ো সমুদ্রবন্দরের একটি ছিলো নাগাসাকি। আর জাপানের যুদ্ধের অধিকাংশ সরঞ্জামও তৈরি হতো নাগাসাকিতেই। জাপানি কোম্পানি মিৎসুবিশি সে সময় জাপানের জন্য যুদ্ধবিমান আর যুদ্ধজাহাজ তৈরি করে দিচ্ছিলো। জাহাজ ধ্বংস করার যে টর্পেডো, সেটাও তারা তৈরি করতো। এই মিৎসুবিশির কারখানাটিও ছিলো নাগাসাকিতে। নাগাসাকির যে এলাকায় বোমাটি ফেলা হয় সেটা স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় আর হাসপাতালের মতো জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানে পূর্ণ।
৯ আগস্টের দিন তিনিয়ন দ্বীপ থেকে বি-২৯ নামে একটি প্লেন বোমাটি নিয়ে নাগাসাকির উদ্দেশে রওনা হয়। ১১টা ১মিনিটে মেঘ একটু কাটলে বক্সকার থেকে ফ্যাটম্যানকে নিচে ফেলা হলো। ঠিক ৪৩ সেকেন্ড পরে মাটি থেকে ৪৬৯ মিটার উপরে বিস্ফোরিত হয় ৬.৪ কেজি প্লুটোনিয়াম সমৃদ্ধ বোমাটি। বিস্ফোরণের শক্তি ছিলো প্রায় ২১ কিলোটন টিএনটির বিস্ফোরণের সমান। আর বিস্ফোরণের ফলে ওখানকার তাপমাত্রা হয়েছিলো ৩৯০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মাত্র ১৫০ জন সৈন্যকে লক্ষ্য করে ফেলা ওই বোমায় নিহতদের অধিকাংশই ছিল নিরীহ যুদ্ধনিষ্পাপ নাগরিক। বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গেই মারা যায় ৭০ হাজার থেকে ৭৫ হাজার মানুষ। আর ৪৫ সালের শেষদিকে মৃতের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ৮০ হাজারে। এরমধ্যে ২ হাজার কোরিয়ান শ্রমিকও ছিলো। ছিলো ৮ জন যুদ্ধবন্দীও। আহত হয় আরো প্রায় ৮০ হাজার মানুষ।
শুধু তাই না, বিস্ফোরণের ফলে পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে প্রায় ১ মাইল এলাকা জুড়ে। এই তেজস্ক্রিয়তার কারণে আরো কতো যে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। আজ হয়ত হিরোশিমার ঘটনার আড়ালে চলে যেতে বসেছে নাগাসাকির সেই দুর্বিষহ ইতিহাস। যদিও হিরোশিমা হামলার কয়েক গুণ বেশি শক্তিশালী ও বিধ্বংসী ছিল নাগাসাকির চিত্র। এর ভয়াবহতা দেখেই জাপানকে করতে হয়েছিল আত্মসমর্পণ। এই সৃতি মনে করে আজও জাপান ভয়ে শিউরে উঠে।
প্রতিক্ষণ/এডি/এনজে