প্রকৃতির রঙে রাঙানো পোশাক
এমন পোশাক পরার মানেই হলো নিজেকে পরিবেশের পক্ষে রাখা। আর আজকাল তো ইকো ফ্যাশনের জয়জয়কা পোশাকশিল্প প্রাকৃতিক উপাদানের প্রতি জোর দিচ্ছে। পরিবেশবান্ধব বা ইকো ফ্রেন্ডলি পোশাকের গুরুত্বও দিন দিন বাড়ছে। চেষ্টা চলছে যাতে ইকো ফ্রেন্ডলি ফ্যাশনের প্রসার ঘটে, আর পোশাকের মান অক্ষুণ্ন থাকে। প্রাকৃতিক রঙের পোশাক তৈরিও গুরুত্ব পাচ্ছে। আমাদের দেশে প্রাকৃতিক রঙ ব্যবহারের ইতিহাস অনেক দিনের। যার সুখ্যাতিও ছিল বিশ্বব্যাপী। ১৮৫০ সালের আগে প্রায় সব ফ্যাব্রিকের রঙ ছিল প্রাকৃতিক। ভেজিটেবল, বিভিন্ন গাছ, পোকামাকড় ইত্যাদি ছিল এর উৎস।
প্রাকৃতিক রঙের ব্যবহার প্রায় চার হাজার বছরের পুরোনো বলে ধারণা করা হয়। মিসরীয় সভ্যতায় এর প্রমাণ পাওয়া যায়। ভারতীয় উপমহাদেশে ১৮২০ থেকে ১৮৬০ সাল পর্যন্ত প্রাকৃতিক রঙ নীলের ব্যাপক চাষ হতো। এর অবশ্য কারণও রয়েছে। সে সময় ব্রিটেনে শিল্পবিপ্লব শুরু হয়। বস্ত্রশিল্পে নীলের চাহিদা বেড়ে যায়।
ফলে ইংরেজদের উপনিবেশে নীল উৎপাদনের ওপর জোর দেয়া হয়। এই কাজে রাজি না হলে চাষিদের ওপর অত্যাচার করা হতো। এক জরিপে দেখা যায়, শুধু ১৮৪৯ থেকে ১৮৫৯ সাল পর্যন্ত ভারতবর্ষে নীল উৎপাদিত হয় ১০ হাজার ৭৯১ মণ। ধীরে ধীরে প্রাকৃতিক রঙের চাহিদা কমতে থাকে। কেমিক্যাল রঙ সহজলভ্য হয়ে ওঠে। একসময় কৃত্রিম রঙের ক্ষতির বিষয়গুলো নিয়ে ভাবাই হতো না। যে পরছে, শুধু সেই নয়, পরিবেশও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে, এ সম্পর্কে মানুষের অজ্ঞতা ও উদাসীনতা ছিল।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রাকৃতিক রঙ নিয়ে কথা বললে প্রথমে যে নামটি আসে, তিনি সৈয়দা রুবী গজনবী। তিনি আশির দশকের শেষে এবং নব্বইয়ের প্রথম দিকে ফ্যাব্রিকে প্রাকৃতিক রঙের ব্যবহার শুরু করেন, যা ছিল বৈপ্লবিক। এটি এখনো চলছে। এ প্রসঙ্গে রুবী গজনবী জানান, প্রাকৃতিক রঙের ব্যবহার আরও বাড়ানো দরকার। আমাদের দেশীয় হাউজগুলোর এগিয়ে আসা উচিত। যদিও প্রাকৃতিক রঙ ব্যবহার করা হলে মান কিছুটা কমে যায়, তবু চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া উচিত। দেশীয় অনেক হাউজ যে কাজ করছে না, এমন নয়।
কুমুদিনী, টাঙ্গাইল শাড়ী কুটির, প্রবর্তনা, যাত্রা, অরণ্য তো রয়েছেই। প্রাকৃতিক রঙে তৈরি প্রডাক্টের প্রতি কীভাবে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করা যায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ক্রেতারা চান প্রাকৃতিক রঙের পোশাক কিনতে। কিন্তু প্রডাক্টের কোয়ালিটি ও দাম- দুটোর ওপর গুরুত্ব দেয়া উচিত। অরণ্য প্রাকৃতিক রঙের ব্যবহার বাড়াতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রেখেছে। প্রথম দিকে সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে সেই কর্মশালাটি পরিচালনা করতো। এখনো কারুশিল্পী ও ছাত্রছাত্রীদের জন্য কোনো কোর্স ফি নেয়া হয় না। রুবী গজনবী আরও বলেন, প্রাকৃতিক রঙের ব্যবহার বাড়ানো উচিত। বিষয়টি যেন এমন না হয় যে, আমি চলে গেলাম আর এই রঙের ব্যবহার থেমে গেল।
অরণ্যের দেয়া এক তথ্যে জানা যায়, প্রায় ৩২টি গাছ আছে, যেগুলো থেকে প্রাকৃতিক রঙ তৈরি করা সম্ভব। এগুলোর বেশির ভাগই আমাদের চেনা। এসব থেকে তৈরি রঙ দিয়ে প্রায় সব ধরনের সুতা ও ফ্যাব্রিক রাঙানো সম্ভব। সুতি, রেয়ন, পাট এবং উলেও কাক্সিক্ষত প্রাকৃতিক রঙ পাওয়া সম্ভব।
৩২টি গাছের পাতা, শিকড়, ছাল, বীজ, ফল, কাঠের গুঁড়া, খোসা দিয়ে রঙ তৈরি করা হয়। যেমন অর্জুন কাঠের গুঁড়া দিয়ে গোলাপি, সুপারির বীজ দিয়ে গাঢ় গোলাপি, খয়ের দিয়ে ব্রাউন ও মেরুন, লটকনের বীজ দিয়ে কমলা এবং নীল বা ইন্ডিগো দিয়ে নীল রঙ তৈরি করা সম্ভব, যা পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ। প্রাকৃতিক কিছু রঙ আবার স্বাস্থ্যের জন্যও বেশ ভালো।
রঙ শুধু পোশাকেই নয়, অন্যান্য হ্যান্ডমেইড পণ্যেও ব্যবহার করা যায়। আর এতে পোশাকের যে দাম বেড়ে যায়, তা নয়। অন্যান্য পোশাকের তুলনায় সেটি ক্রয়সীমার মধ্যেই রাখা যায়। সবচেয়ে বেশি যা লাভ, তা হলো সার্বক্ষণিকভাবে প্রকৃতির আপন হয়ে থাকা গেল!
প্রতিক্ষণ/এডি/তাজিন