প্রাকৃতিক নাবিক পরিয়ারী পাখি
নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রতিক্ষণ ডটকম:
পাখি পরিযান বলতে নির্দিষ্ট প্রজাতির কিছু পাখির প্রতি বছর বা কয়েক বছর পর পর একটি নির্দিষ্ট ঋতুতে বা সময়ে কম করে দু’টি অঞ্চলের মধ্যে আসা-যাওয়াকেই বোঝায়। জীবজন্তুর ক্ষেত্রে মাইগ্রেশন (Migration) এর সঠিক পরিভাষা হচ্ছে সাংবাৎসরিক পরিযান। যে সব প্রজাতির পাখি পরিযানে অংশ নেয়, তাদেরকে পরিযায়ী পাখি বলে। এ পাখিরা প্রায় প্রতিবছর পৃথিবীর কোন এক বা একাধিক দেশ বা অঞ্চল থেকে বিশ্বের অন্য কোন অঞ্চলে চলে যায় কোন একটি বিশেষ ঋতুতে।
সে ঋতু শেষে সেগুলো আবার ফিরে যায় যেখান থেকে এসেছিল সেখানে। এমন আসা যাওয়া কখনো এক বছরে সীমিত থাকে না। এ ঘটনা ঘটতে থাকে প্রতি বছর এবং কমবেশি একই সময়ে। কিছু প্রজাতির মাছ, স্তন্যপায়ী প্রাণী এমনকি পোকামাকড়ও ফিবছর পরিযান ঘটায়। তবে পাখির মত এত ব্যাপক আর বিস্তৃতভাবে কেউই পরিযানে অংশ নেয় না। পৃথিবীর প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির পাখির মধ্যে ১৮৫৫ প্রজাতিই (প্রায় ১৯%) পরিযায়ী।
অতিথি পাখি কেন আসে কেন যায়? এর উত্তর খুব সহজেই দেওয়া যায়, শীত এলে এরা সহ্য করতে না পেরে অন্য দেশে যেখানে শীত অপেক্ষাকৃত কম সেখানে চলে যায়। তাছাড়া এ সময়টাতে শীতপ্রধান এলাকায় খাবারেও দেখা যায় প্রচণ্ড অভাব। কারণ শীতপ্রধান এলাকায় এ সময় তাপমাত্রা থাকে অধিকাংশ সময় শূন্যেরও বেশ নিচে। সেই সাথে রয়েছে তুষারপাত। তাই কোনো গাছপালা জন্মাতেও পারে না। তাই শীত এলেই উত্তর মেরু, সাইবেরিয়া, ইউরোপ, এশিয়ার কিছু অঞ্চল, হিমালয়ের আশপাশের কিছু অঞ্চলের পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে চলে আসে কম ঠাণ্ডা অঞ্চলের দিকে।
বসন্তের সময় মানে মার্চ-এপ্রিলের দিকে শীতপ্রধান অঞ্চলের বরফ গলতে শুরু করে, কিছু কিছু গাছপালা জন্মাতে শুরু করে। ঘুম ভাঙতে শুরু করে পুরো শীতকালে ঘুমিয়ে থাকা অনেক প্রাণীদের। ঠিক এ রকম এক সময়ে অতিথি পাখিরা নিজ বাড়িতে ফিরে যায় দলবলসহ। আবার এখানে বেশ মজার একটা ব্যাপার আছে। তারা ফিরে গিয়ে ঠিক তাদের বাড়ি চিনে নেয়। অদ্ভুত এক ব্যাপার। গবেষকরা বলছেন, সমুদ্রের নাবিক যেমন কম্পাস ব্যবহার করে পথ চলে এই পাখিদের দেহে সেরকম কিছু একটা জন্মগতভাবেই আছে।
যা তাদের পথ চলার সময় দিক চিনতে সাহায্য করে। তাছাড়া তারা সূর্য ও তারার অবস্থানের উপরই নির্ভর করে। পরিষ্কার মেঘমুক্ত রাতে যখন আকাশে নক্ষত্র দেখা যায় তখন পাখিরা নির্বিঘ্নে পথ চলতে পারে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু আকাশ মেঘলা থাকলে নক্ষত্র ঢাকা পড়ে। এ সময় এসব পাখিরা আকাশ থেকে নিচে কোনো নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেয়। কিন্তু সমুদ্রের উপর দিয়ে উড়ে চলা পাখিরা এক্ষেত্রে দিকভ্রান্ত হয়। তাই এ সময় অনেক দূরের কোনো লাইটহাউসের শক্তিশালী আলোর দিকে তারা পথ ভুল করে চলে আসে দলে দলে। এছাড়াও কিছুর মজার তথ্য দেওয়া হলো
১। Migratory শব্দটি ল্যাটিন Migratus থেকে এসেছে। এর অর্থ হল ‘পরিবর্তন’ এবং এটি নির্দেশ করে পাখিরা কিভাবে বিভিন্ন মৌসুমে তাদের ভৌগলিক অবস্থান পরিবর্তন করে।
২। পাখি পরিযান সর্বোচ্চ পর্যায় পৌঁছায় বসন্ত ও শরৎকালে। তবে আমাদের দেশে শীতের শুরুতেই নতুন নতুন পাখি আসতে দেখা যায়। তবে বাস্তবতা হল বছরে ৩৬৫ দিনই পরিযাণ ঘটে। পাখি কখন পরিযান করে তা পাখির প্রজাতি, আবহাওয়া, খাদ্যপ্রাপ্তি, প্রজনন ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভর করে থাকে।
৩। পরিযায়নকাল খাদ্য গ্রহণের প্রবণতা বাড়িয়ে দেয় (Hyperphagia)। ফলে তাদের শরীরের চর্বির পরিমাণ বেড়ে যায়। এই চর্বি পরবর্তীতে ভ্রমণের সময় প্রয়োজনীয় শক্তির যোগান দেয়। কিছু পাখির ওজন সপ্তাহান্তেই দ্বিগুণ বাড়তে পারে!
৪। একটানা পরিযায়ন কয়েক সপ্তাহ থেকে চার মাস পর্যন্ত হতে পারে।
৫। বাজপাখি, সুইফট বার্ড, হাঁস কিংবা বিভিন্ন জলজ পাখি সকালের দিকে পরিযান করে। অপরদিকে গায়ক পাখিরা রাতে করে থাকে। মূলত শিকারের কবল থেকে বাঁচতেই তারা এ্মন সময়কে পছন্দ করে। এছাড়া এই সময়ে সূর্যের তাপমাত্রাও কম থাকে।
সাধারণত আমরা জানি শীতকালে ঠান্ডার প্রকোপে কিছুটা উত্তাপ পাওয়ার আশায় আমাদের দেশে অনেক পাখি আসে। জলের বুকে কিংবা গাছের ডালে উড়ে বেড়ায়। শীত শেষে আবার পূর্বের অবস্থানে ফিরে যায়। একটু ভাবুনতো আমরা কোথাও বাঁচার জন্য আশ্রয় নিয়ে দেখলেন আশ্রয়দাতাই আপনার মৃত্যুর কারণ তবে কেমন লাগবে আপনার? আবার ভেবে দেখুন এসব পাখি শিকার ছাড়াই কিন্তু আপনার ৯ – ১০ মাস কেটে গেছে। সুতরাং শীতের এই সব পাখিকে শিকার না করলেও আমাদের চলবে।
প্রতিক্ষণ/এডি/আকিদ