প্রেতাত্মার আনাগোনা….
ইয়াসীন পাভেল, প্রতিক্ষণ ডট কম:
মানুষ সব সময়ই রহস্যপ্রিয়। অতিপ্রাকৃত বা ব্যাখ্যার অতীত বিচিত্র সব বিষয় নিয়ে মানুষের বেশি আগ্রহ। তবে পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত, সৃষ্টির আদি থেকে আজকের আধুনিক সময় পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি চর্চিত বিষয় হচ্ছে ভূত। এ অদৃশ্য অলৌকিক এবং কাল্পনিক অবয়বটির প্রতি একটা বয়সে অনুসন্ধিৎসা থাকে প্রবল।
বিষয়টি হয়তো ওই অর্থে বিজ্ঞাননির্ভর নয়। তবুও মানুষের মন থেকে অলৌকিক বিষয় একেবারে মুছে দেওয়া মোটেই সহজ কাজ নয় । বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তিরা ভূত-প্রেত বা এরকম অলৌকিক বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালালেও বিশ্বজুড়ে ভূতের অস্তিত্ব মেনে নিতে অনেকেই এখনো দ্বিধাহীন।
ভূতের অস্তিত্বের প্রমাণ কাগজে-কলমে দেওয়া হয়তো সম্ভব নয়। কিন্তু বিশ্বসাহিত্যের দিকে তাকালে দেখা যায় এর অনেকটা জুড়েই রয়েছে ভূত। এক্ষেত্রে ভূত সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করল, নাকি সাহিত্য ভূতের অস্তিত্ব স্বীকার করল, এ প্রশ্ন বহু পুরনো। সেই প্রাচীন সাহিত্যে সংস্কৃতি গ্রিক, রোমান, ল্যাটিন, হিবরু, চিনা, আরবি ইত্যাদি। লেখা হয়েছে ভূতবিষয়ক হাজার হাজার রচনা। আবার অনেক রচনায় অত্যাবশ্যকভাবে এসেছে ভূত। পরবর্তীকালে, মধ্যযুগে বা তারও পরে, যখন সাহিত্য রোমান্টিসিজমের পুনরুত্থান ঘটল তখন [ষোড়শ শতকের গোড়া থেকে ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত], তাতেও নানাভাবে এই ভূত, প্রেত, অপদেবতা বা ডাইনিদের প্রসঙ্গ এসেছে। প্রায় পাঁচশ বছর আগে থেকেই এর সূচনা। শেকসপিয়রের বিভিন্ন নাটকে প্রেতাত্দার অস্তিত্ব কম-বেশি সবারই জানা। এর মধ্যে হ্যামলেট, ম্যাকবেথ, টেমপেস্ট মিউসামার নাইটস ড্রিম তো বহুল চর্চিত নাটক। এসব গল্পের কোথাও অশরীরী ভবিষ্যৎ বক্তা, কোথাও প্রতিশোধ নেওয়া ভূত, কোথাও ধোঁয়ার মতো এরিয়েল আবার কোথাও অন্যকোনো অবয়বে এসব ভূত বা অলৌকিক অশরীরী বিরাজমান রয়েছে।
পশ্চিমারা বিশ্বাস করে ভূতের অস্তিত্ব রয়েছে। তাদের মতে, প্রাণীর শরীর থেকে আত্মা চলে গেলেই সে প্রাণহীন হয়ে যায়। কোনো কোনো আত্মা প্রাণীর শরীর থেকে বের হওয়ার পরও ফিরে আসে। আর এই ফিরে আসা আত্মাই হচ্ছে ভূত। কোনো শরীরী রূপ তার থাকে না। সে থাকে অস্পষ্ট। কিন্তু তার চালচলন স্বাভাবিক জীবিত শরীরের মতো। তাকে স্পষ্ট দেখা যায় না। তবে উপলব্ধি করা যায়। কোথায় কোথায় ভূতের অস্তিত্ব থাকে এ নিয়ে তারা গবেষণাও করেছেন। তারা মনে করেন, আশপাশের জায়গা থেকে যদি কোনো জায়গা ঠাণ্ডা হয়ে থাকে তাহলে বুঝতে হবে এখানে ভূত আছে বা খানিক আগে ছিল। ভূতদের উপস্থিতিতে বৈদ্যুতিক জিনিসপত্র নানা রকম অদ্ভুত আচরণ করে। যেমন, বাতি জ্বলে-নেভে, রেডিও অন-অফ হয়, টিভি ঝিরঝির করে, কোনো কিছু অকারণে নড়াচড়া করে ইত্যাদি। শুধু বাড়ি কিংবা রাস্তা নয়, ভূতের দেখা মেলে রাজপ্রাসাদেও।
হ্যাম্পটন ফোর্ট প্রাসাদে দেখা দেন রাজা অষ্টম হেনরি, তার ছয়জন স্ত্রীকে নিয়ে। এদের মধ্যে অ্যান বোলিন ও জেন সিমুরকে হত্যা করা হয়েছিল শিরচ্ছেদের মাধ্যমে। মুণ্ডুহীন অবস্থাতেই ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় তাদের ছায়াশরীর। তবে ভূতের সংখ্যায় সব কিছুকে ছাড়িয়ে গেছে টাওয়ার অব লন্ডন। অ্যান বোলিনের আত্মা উদয় হয় এখানেও। সেই সঙ্গে দেখা মেলে টমাস বেকেট, স্যার ওয়াল্টার র্যালে, লেডি জেন গ্রের ভূতের। সলিসবারির অষ্টম কাউন্টসের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছিল এখানেই। সেই ঘটনা রাতে এখনো দেখা যায় এখানে। একটি ভল্লুককেও নাকি দেখা গেছে টাওয়ারের সিঁড়ি দিয়ে নামতে। রাতের পাহারাদার সেই ভল্লুককে বন্দুকের বেয়োনেট দিয়ে আঘাত করলে, তার ছায়াশরীর ভেদ করে যায় বেয়োনেট এবং সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে যায় সেই ভল্লুকও।
উইনচেস্টার ম্যানশনের বদ্ধ রান্নাঘর থেকে আজো নাকি ভেসে আসে খাবারের গন্ধ, বদ্ধ রুমের ভেতরে বসে কেউ যেন অর্গান বাজায়। পাওয়া যায় মানুষের হেঁটে-চলে বেড়ানো আর নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ। ওয়াশিংটন ডিসির ১৬০০ পেনসিলভেনিয়া এভিনিউর হোয়াইট হাউস শীর্ষক বাড়িটি কেবল আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্টের বাসভবনই নয়, এটি একটি ঐতিহাসিক ভবনও বটে।
আমেরিকা যখন আধুনিকতার মোড়কে ডিজিটাল বিশ্ব গড়ার নেতৃত্ব দিচ্ছে তখন তাদের প্রেসিডেন্টের বাসভবনে ঘুরে বেড়াচ্ছে ডজনখানেক প্রেতাত্মা এমন বিশ্বাস কেবল ভৌতিক গল্পপ্রিয় সাধারণ আমেরিকানদেরই নয়, হোয়াইট হাউসের একাধিক সাবেক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিজেদের এসব ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বলে দাবি করেন। হোয়াইট হাউসের পুব দিকের একটি কক্ষে প্রায়ই কাজে ব্যস্ত থাকেন হোয়াইট হাউসের প্রথম ফার্স্টলেডি এবিগেইল অ্যাডামসের ভূত। আবার মরার পরও বাগানে কাজ করে যাচ্ছেন হোয়াইট হাউসের কর্মচারী ডলি ম্যাডিসন।
শুধু তারাই নন, আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন, রুজভেল্ট, হ্যারিসন, রিগ্যান, অ্যান্ড্র– জ্যাকসনসহ অনেকের প্রেতাত্মা এখনো ঘুরে বেড়ায় হোয়াইট হাউসে। সবচেয়ে বেশি দেখা যায় প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের ভূতকে। মিসেস ম্যারি টড লিঙ্কন স্বামীর প্রেসিডেন্সির সময়ই পুত্র উইলিকে হারান। হোয়াইট হাউসের গ্রিন রুমে বসে মৃত পুত্রের সঙ্গে প্ল্যানচেটের মাধ্যমে মাঝে মধ্যে যোগাযোগের চেষ্টা করতেন। হোয়াইট হাউসের ভূত কাহিনীতে একটি বিষয় লক্ষণীয়, তা হচ্ছে এখানকার কোনো ভূতই আশ্চর্যজনকভাবে কারো কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করেনি। ভূতপ্রিয় আমেরিকানদের কাছে এগুলো বিশ্বাসযোগ্য ভৌতিক ঘটনা হলেও অনেকের কাছে এগুলো গালগল্প ছাড়া আর কিছুই নয়।