ফিরে যাই নীল ইতিহাসে
প্রতিক্ষণ ডেস্ক
বলা হয়ে থাকে বেদনার রঙ নীল। নিশ্চয় মনে একবারের জন্য হলেও উঁকি দিয়েছে, কেন বেদনার রঙকে লাল,সবুজ কিংবা হলুদ না বলে নীল বলা হয়? সাপ কামড় দিলে কষ্টে ও বিষের যন্ত্রণায় মানুষের মুখ ও শরীর নীল হয়ে যায়, শরীরের কোনও স্থান আঘাতপ্রাপ্ত হলে ঐ স্থানের রক্ত জমাট বেধে নীল হয়ে যায়। তাই অনেকের ধারণা এসব কারণেই বেদনার রঙকে নীল বলা হয়। কিন্তু এই নীলের নীল কাহিনী এখানেই সীমাবদ্ধ নয়।
এর আছে অনেক কথা এবং মর্মস্পর্শী ইতিহাস। নীলচাষ, নীলবিদ্রোহ, নীলকর এ শব্দগুলো আজও আমাদের মনে বিভীষিকাময় কিছু দিনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তবে ইতিহাসের এই অধ্যায় আমরা প্রায় ভুলেই যেতে বসেছি। একসময় ইংরেজরা আমাদের দেশের কৃষকদের দিয়ে জোর করে নীল চাষ করাতো। তাদের জুলুমে বাধ্য হয়ে ফসলের জমিতে নীল চাষ করতেন কৃষকেরা। তাই ব্রিটিশ আমলে নীল চাষ নিয়ে কৃষকদের মনে ছিল আতঙ্ক। এ নিয়ে বিদ্রোহও হয়েছে। সে সময়ের সমাজব্যবস্থা ও নীল বিদ্রোহ নিয়ে দীনবন্ধু মিত্র নীল-দর্পণ নামের একটি বইও লিখেছেন । অনেকে হয়তো জানেই না, নীল গাছ থেকে নীল সংগ্রহ করা হতো। এই ঐতিহাসিক গাছটি এবং এর বিভিন্ন দিক সম্পর্কে কৌতূহলী পাঠকদের জন্য আজকের আয়োজনে থাকছে নীল ইতিহাস।
নীল চাষ ও বিদ্রোহ
বহু বছর আগেই নীল চাষ এদেশ থেকে উঠে গেছে। কিন্তু একখনও দু-একটি নীল গাছের দেখা পাওয়া যায় বিধ্বস্ত নীল কুঠিগুলোর আশেপাশের এলাকায়। নীল গাছের নাম শুনলেই মানুষের মনে জেগে উঠে অতীত দিনের কৃষক শোষণের ইতিহাস। এই উপমহাদেশের মাটি নীল চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী হওয়ায় বৃটিশ নীলকরেরা বিপুল পুঁজি বিনিয়োগ করে নীলচাষ করার জন্য।এবং নীল চাষের নামে কৃষকদের উপর চালানো হতো অমানবীক অত্যাচার। নদীয়া, যশোর,ঝিনাইদা, বগুড়া, রংপুর প্রভৃতি জেলায় নীলচাষ ব্যাপক ভাবে করা হতো। উনিশ শতকের শেষের দিকে নীলচাষ অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক না হওয়ায় কৃষকরা ধান ও পাট চাষের দিকে ঝুকে পড়ে। বৃটিশ নীলকরেরা অত্যাচার আর নিপীরনের মাধম্যে নীলচাষে বাধ্য করলে ১৮৫৯-৬০ সালে নীলচাষীরা এর বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলে। এর পরে বাংলায় নীল চাষ একটু একটু করে বিলুপ্ত হয়ে যায়। এছাড়া ১৮৮০ সালে ‘অ্যানিলিন’ (রঞ্জকপদার্থ)আবিষ্কৃত হওয়ায় এর চাহিদা কমে যায়।
-বীর তিতুমীরের নেতৃত্বে ১৮২৩ সাল থেকে ১৮৩১ সাল পর্যন্ত অত্যাচারী জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা হয়।
-১৮৪০ সাল থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত দুদুমিয়ার নেতৃত্বে নীলকরদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ সংঘঠিত হয়।
-১৮৫৯ সাল থেকে ১৯৬১ সালের মধ্যে বাংলার সর্বত্র প্রজাসাধারনের নেতৃত্বে ব্যাপক নীল বিদ্রোহ হয়।
-১৮৮৯ সালের মাগুরা-মুহম্মদপুর ও কুষ্টিয়া এলাকার সর্বশেষ নীলবিদ্রোহ সংঘঠিত হয়।
নীল গাছ
বহুবছর আগেও এদেশে নীল গাছের অস্তিত্ব ছিল। একটি গুল্ম জাতীয় গাছ, দেখতে অনেকটা ধঞ্চে গাছের মত। বনে জঙ্গলে জন্মাতো।মানুষ একে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করত। গাছটি ১০/১২ ফুট উঁচু হয়। কিন্তু নীল গাছের কষের যে এত দাম ছিল তা এদেশবাসীর জানা ছিল না। বহু বর্ষজীবি গাছ হলেও একসময় এক বর্ষজীবি হিসেবে চাষ করা হতো। এর পাতাগুলো হালকা থেকে গাঢ় সবুজ এবং ফুল গুলো গোলাপী রঙের। এর শিকড় মাটিতে নাইট্রোজেন সংবন্ধন করে মাটির উর্বরতা বাড়ায়। বর্তমানে বেশীরভাগ নীল রঙকে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে কৃত্রিম উপায়ে উৎপন্ন করা হয়। অথচ একসময় নীল রঙয়ের একমাত্র উৎস ছিল এই নীল গাছ।
নীল রং সংগ্রহ
পাতাগুলো বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় প্রক্রিয়াজাত করণের মাধ্যমে নীল রঙ সংগ্রহ করা হয়। প্রথমে পাতা সংগ্রহ করে পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয় । তারপর বড় কড়াইয়ে পানির মধ্যে প্রায় ১২ ঘণ্টা ডুবিয়ে রাখলে তা থেকে সবুজ রঙ এর নির্যাস রের হয়। এরপর সেই নির্যাস নতুন পাত্রে ঢেলে দ্রবনটিকে কাঠি দিয়ে অনেক্ষন নাড়তে হয় যাতে নীল বাতাসের অক্সিজেন এর সংস্পর্শে আসে। এর ফলে অদ্রাব্য নীলের তলানী নীচে জমা হয়। পড়ে তা পৃথক করে শুকিয়ে টুকরো টুকরো করে কাটা হয়।
ভেষজ গুণ
এই গাছের ভেষজগুনও আছে অনেক। প্রাচীন ভারতে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে নীলের প্রশস্তি আছে। আধুনিক কবিরাজি চিকিৎসায় নীলের শিকড় ও পাতা ব্যবহৃত হয়। বৈদ্যরা,এ গাছকে হুপিং কফ নিবারক, বক্ষ ও মূত্রাশয়ের রোগ, প্লীহা ও যকৃতবৃদ্ধি রোগে ব্যবহার করতে নির্দেশ দেন। পাতার রস মৃগীরোগীর জন্য উপকারী।
নীল গাছের বিস্তৃতি
প্রাকৃতিক ভাবে নীল গাছ এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু অংশে জন্মে। তবে সারা বিশ্বের অনেক দেশেই নীল চাষ করা হয়। মিশরের ১৮তম রাজবংশের মমিগুলি নীল রঙ এর কাগজে মোড়ানো অবস্থায় পাওয়া যায়।
বর্তমানে আমাদের দেশে এখন ঢাকা বোটানিক্যাল গার্ডেন সহ মাত্র কয়েকটি জায়গায় এই গাছ রয়েছে। তাছাড়া রংপুর ও দিনাজপুর জেলায় সবুজ সার ও ভূমিতে নাইট্রোজেন সরবরাহের জন্য এর কিছু চাষ হয়ে থাকে। এছাড়াও রংপুর জেলায় প্রাকৃতিক রঙ হিসেবে এর চাষ হচ্ছে।
প্রতিক্ষণ/এডি/জেডএমলি