বেকারত্ব ঘুচাতে পারে পান চাষ
কৃষি প্রতিবেদক, প্রতিক্ষণ ডটকম:
আমাদের অর্থনীতির চাকা কৃষির উপর নির্ভরশীল। এদেশে অনেক আগে থেকেই পান চাষ হয়ে আসছে।বাংলাদেশে অন্যান্য অনেক অর্থকরী ফসল চাষের চেয়ে পান চাষ অনেক লাভজনক। অথচ এই খাতকে অবহেলা করা হয়েছে প্রথম থেকেই। সনাতন নিয়ম ছেড়ে আধুনিক জ্ঞানের আলোয় গবেষণাভিত্তিক পান চাষ করে ১ বিঘা জমি থেকে বছরে ২/৩ লক্ষ টাকা আয় করা যায়।
সারা বিশ্বে পানের জাতের সংখ্যা প্রায় ১০০টির মত। আমাদের দেশে ১০/১২ টি জাতের পান চাষ হয়ে থাকে। ভেষজ চিকিৎসায় পানের ব্যবহার হয় অনেকভাবে। পানে প্রধান ৭টি শিরা থাকে। এজন্য পানকে সপ্তশিরা বলেও অনেক অভিহিত করে থাকে। পান অত্যন্ত নরম, রসালো বলে সহজেই জীবাণু আক্রান্ত হয়ে পচে যায়। বছরে দুবার লতা নামানোর হিসেব অনুসারে একটি পানের লতা সাধারণত ১২/১৩ হাত লম্বা হয়ে থাকে। এই হিসেব অনুসারে দেখা যায় ২০ বছরে ২৪০/২৫০ হাত পর্যন্ত একটি লতা লম্বা হতে পারে। এ হিসেবে মনে করা হয় পানলতাই পৃথিবীর দীর্ঘ উদ্ভিদ লতা।
দো-আঁশ মাটি পান চাষের জন্য উপযোগী। অপেক্ষাকৃত উচু জমিতে পান চাষ করতে হয়। ১ বিঘা জমিতে ৫০/৬০ মণ জৈব সার ছিটিয়ে চাষ দিতে হয়। ৭ দিন পর ১ কেজি তুঁতে ও ৩ মণ পাথুরে চুন ফুটিয়ে গুড়া করে জমিতে ছিটিয়ে পানি সেচ দিতে হবে। তারপর মই দিয়ে সমতল করে ঘনঘন সেচ দিয়ে মাটি শক্ত করে নিতে হবে। সেচ দেবার সময় খেয়াল রাখতে হবে পানি যাতে জমির বাইরে চলে না যায়। এরপর বাঁশ, খুঁটি, চটা ইত্যাদি দিয়ে বরজ তৈরি করতে হয়। পান চাষ ছায়াযুক্ত স্থান লাগে।
বাংলাদেশের সব জেলাতে কম বেশি পান চাষ হলেও বেশি চাষ হয় দৌলতপুর, বাগের হাট, ফুলতলা, নড়াইল, নোয়াপাড়া, ভেড়ামারা, বিত্তিপাড়া, লক্ষ্মীপুর, বগুড়া, চট্টগ্রাম, বেতকা, নলডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, হরিণাকুণ্ডু, কালীগঞ্জ জেলায়। তবে বাংলাদেশের মধ্যে রাজশাহীর পান সবচেয়ে ভাল।
পানের সাথে আদা, হলুদ, মরিচ, পটল, সুপারি ইত্যাদির চাষ করা যায়। এরপর লতামরা বা বরজ ভাঙ্গা জমিতে লাউয়ের চাষও করা যায়।
আমাদের দেশ থেকে কয়েকটি দেশে পান রপ্তানী করা হয়। আমাদের দেশ থকে পান আমদানীকারক দেশগুলো হলো- পাকিস্তান, যুক্তরাজ্য, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, আবুধাবী, কাতার, সৌদি আরব, কুয়েত, সিরিয়া, তুরস্কো, ইরান, ইরাক সহ বেশ কয়েকটি দেশ। বিশ্বের মধ্যে ভারত, বার্মা, মালয়েশিয়া, ইন্দোচীন, বাংলাদেশে ও পাকিস্তানের প্রায় ১০০ কোটি লোক পান চিবিয়ে থাকে।
পানের ফলন ভালো পেতে হলে উন্নতমানের উপকরণ দিয়ে বরজ তৈরি, প্রতিদিন বরজ দেখাশোনা, ভাল জাতের রোগমুক্ত লতা লাগানো, চারা গাছের যত্ন, লতা উঠলে শক্ত কাঠি ব্যবহার করা, ডগা ঝুলে পড়তে না দেয়া, বরজের ছাউনি নিবিড় ঘন না করা, উপরের গাছের ডালপালা ছেটে দেয়া, আস্তে করে লতা নামানো বা পাতা তোলা, বয়সী পান না রেখে দ্রুত বাজারজাত করা, জৈব সার ব্যবহার ও তাপমাত্রা নির্ধারণ করা, ‘জো’ মতো সেচ দেয়া, এক সারি থেকে অন্য সারির দূরত্ব ৪০ থেকে ৫০ ইঞ্চি হওয়া, লোনা মাটি পরীক্ষা করে চুন প্রয়োগ করা, লতার সাথে শাখা ডাল না রাখা, পোকামাকড় ও রোগব্যাধি সনাক্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া, রোগা পাতা বা লতা না রাখা, তিনহাত খোপে দু’কাতারে ১৪ থেকে ১৬টির বেশি লতা না রাখা, বৃষ্টির সময় জমিতে কাদাপানি জমে থাকলে লতা মাটিতে ফেলে না রাখা, লতা থেকে শাখা ভেঙ্গে দেয়া ইত্যাদির দিকে লক্ষ্য করলে ভাল ফলন পাওয়া সম্ভব।
রোগ-বালাই ও প্রতিকার:
আমাদের দেশে পানের যে সমস্ত রোগবালই দেখা যায় তাহলো গোড়া পচা, লতা পচা, পাতা পচা, ডগা পচা, আগা পোড়া, পাতা পোড়া, পাতা বিবর্ণ হওয়া, পাতায় ফোটা ফোটা দাগ ধরা, পাতা হলুদ হওয়া, লতায় সাদা পচা ইত্যাদি রোগে পানের লতা আক্রান্ত হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনষ্টিটিউটের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ এক গবেষণার মাধ্যমে পানের কয়েকটি রোগ নির্ণয় করে তা প্রতিরোধ ও প্রতিকারের ব্যবস্থা দিয়েছেন। নোইন, রডোমিল গোল্ড, ফলিকুর ও মিলোডি ডুও (বায়ার) ১% বৌর্দ্রো মিশ্রণ। ক্যালিক্রন ৭৫ ইসি (বায়ার) সেপলিন ইত্যাদি রোগের প্রতিকার ব্যবস্থা। এই জীবাণু নাশকগুলো যেকোন একটি কোম্পানীর অনুমোদিত মাত্রায় ১৫ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে। বেশি রোগের প্রকোপ দেখা দিলে ৭ দিন পর পর লতায়পাতায় স্প্রে করতে হবে।
পানের পাতা বড় এবং চক চকে রঙ ও ভাল গঠন করার জন্য ভক্রসল সুপার (বায়ার) পান তোলার ১৫ দিন আগে পাতায় স্প্রে করতে হবে। ১% বৌর্দ্রো মিশ্রণ এবং বাইরো প্লেক্স সারটি প্রয়োগ করে ভালো সুফল পাওয়া যাবে। পরীক্ষা করে দেখা গেছে নিয়মিত ১% বৌর্দ্রো মিশ্রণ ১৫ দিন পর পর স্প্রে করলে সব রোগ থেকে পানলতাকে রক্ষা করা যায়।
পান চাষে আধুনিক জ্ঞানের অভাব চাষীদের মধ্যে লক্ষ করা যায়। একমাত্র বৈজ্ঞানিক উপায়ে পান চাষ করে পানের উন্নতি ও ফলন বাড়ানো সম্ভব। পান চাষে সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয় অগ্রণী ভূমিকা পালনের পাশাপাশি কৃষকদের ঋণ প্রদান ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে পান চাষে সমৃদ্ধি আনা সম্ভব।
প্রতিক্ষণ/এডি/মাসুদ