বেড়িয়ে আসুন টাকা জাদুঘর
সাদিয়া এইচ. তানহাঃ
“ভাইয়া, টাকা জাদুঘরটা কোথায়?” অন্তত ১০-১২ জনকে এই প্রশ্ন করেও কোন সদুত্তর পাওয়া গেলনা। বুঝতে পারলাম যে, আমি যতই টাকা জাদুঘরের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার কথা চিন্তা করে তা দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকি না কেন টাকা জাদুঘর এখনো আসলে সাধারণ মানুষের কাছে অতটা পরিচিত হয়ে ওঠেনি।
যাই হোক, অবশেষে অনেক খোঁজাখুঁজির পর মিরপুর ২ এ কিডনি ফাউন্ডেশন হসপিটাল ও রিসার্চ ইন্সটিটিউটের পাশে খুঁজে পেলাম ২০০৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে কারেন্সি মিউজিয়াম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ও ২০১৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশের একমাত্র টাকা জাদুঘরটিকে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, টাকা জাদুঘরে প্রবেশ করতে কোন টাকা লাগে না। আর টাকা জাদুঘরের প্রবেশ পথটিও দারুনভাবে সজ্জিত। প্রবেশ পথের সিড়িটির পুরোটাই টবের গাছ দিয়ে সাজানো। এছাড়া জাদুঘরের প্রথম ভবনটির দেওয়াল ঘেঁষে স্থাপন করা হয়েছে স্টিল স্ট্রাকচারে তৈরি একটি নান্দনিক টাকা গাছ। আবার প্রবেশ পথের ডানদিকের দেওয়ালে রয়েছে পোড়ামাটির শিল্পকর্ম দিয়ে তৈরি ম্যুরাল যা টাকা জাদুঘরের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তুলেছে বহুগুণে।
টাকা জাদুঘরের নিদর্শনগুলো এর দুটি গ্যালারিতে প্রদর্শিত হয়। এই দুই গ্যালারিতে আবার রয়েছে ৪০ টি শোকেস। এই শোকেসগুলোতে সাজানো আছে বাংলাদেশ ও সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক রাজত্বের চালিকাশক্তি অর্থের বিভিন্ন প্রকারভেদ। কাগজের নোট, ধাতব মুদ্রা, নমুনা নোট, প্রাইজবন্ড, চেক, এমনকি কড়ি – কি নেই এই জাদুঘরে! অর্থের সমকালীন এবং ঐতিহাসিক নিদর্শনের সমৃদ্ধ সংগ্রহশালা এই জাদুঘর।
জাদুঘরের প্রথম গ্যালারিটি মূলত বাংলাদেশ ও ভারতীয় অঞ্চলে মুদ্রার বিবর্তনের ইতিহাসকে ধারণ করে আছে। এর ১ নং শোকেসে আছে মৌর্য শাসনামলের ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা যা বাংলাদেশের তথা ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম মুদ্রা। এরপরের শোকেসগুলোতে ধারাবাহিকভাবে সজ্জিত আছে কুষাণ রাজাদের মুদ্রা, হরিকেল রাজাদের মুদ্রা, দিল্লির সুলতানদের মুদ্রা, সুলতানি বাংলার স্বাধীন শাসকদের মুদ্রা, মুঘল সম্রাটদের মুদ্রা, ব্রিটিশ ভারতের মুদ্রা ও পাকিস্তান আমলের মুদ্রা এবং কাগজী নোট। শুধু যে সুদূর এবং অদূর অতীতের মুদ্রা ও কাগজী নোট দিয়েই সাজানো হয়েছে ১ নং গ্যালারি তা নয়, বরং এখানে প্রদর্শিত হচ্ছে আধুনিক বাংলাদেশের বিভিন্ন সময়ে প্রচলিত মুদ্রা, কাগজী নোট এবং স্মারক মুদ্রা ইত্যাদি। অর্থ্যাৎ একই সঙ্গে বাংলাদেশের টাকার অতীত ও বর্তমানকে আগলে রেখেছে টাকা জাদুঘরের এই গ্যালারি।
অসংখ্য মুদ্রার ভিড়ে ১ নং গ্যালারির যে জিনিসটি আপনাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করতে পারে তা হলো গ্যালারির পূর্ব দিকের দেওয়াল জুড়ে বিস্তৃত ৩টি শৈল্পিক ডিওরামা যার মাধ্যমে মুদ্রা পূর্ববর্তী যুগে প্রচলিত পণ্য বিনিময় প্রথা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এছাড়া গ্যালারি ১ এ আরো রয়েছে বর্তমানে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া দেশসমূহের কাগজী নোট।
গ্যালারি ১ থেকে বেরিয়ে চলুন যাওয়া যাক গ্যালারি ২ এ। এই গ্যালারিটিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রার তীর্থস্থান বলা যায়। এখানকার বিভিন্ন শোকেসে সাজানো রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাগজী নোট ও স্মারক মুদ্রা। আমাদের দেশে সুপরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ইংল্যান্ড বা অষ্ট্রেলিয়ার মতো দেশের মুদ্রা, ব্যাংক নোট, নমুনা নোট প্রভৃতি যেমন এই গ্যালারিতে প্রদর্শিত হচ্ছে, তেমনি আবার আমাদের দেশের সাধারণ জনগণের নিকট মোটামুটি অপরিচিত দেশগুলো যেমন সামোয়া, কিরিবাতি, রিপাবলিক অব সিসিলি, বতসোয়ানা, বুরুন্ডি প্রভৃতি দেশের স্মারক মুদ্রা, ব্যাংক নোট, নমুনা নোট প্রভৃতিও এখানে বিরাজ করছে সমহিমায়। এছাড়া গ্যালারি ২ এর গুরুত্বপূর্ণ আকর্ষণের মধ্যে রয়েছে লক্ষ টাকার স্যুভেনির নোটে ফটো কিয়স্কের মাধ্যমে টাকা জাদুঘর পরিদর্শনের স্মৃতি অম্লান করে রাখার ব্যবস্থা।
টাকা জাদুঘরের দুইটি গ্যালারিতে কোন প্রদর্শনী দ্রব্যের পুনরাবৃত্তি না হলেও একটি জায়গায় তারা মিলে গেছে। দুটি গ্যালারিতেই আছে টাচ স্ক্রিন, ডিজিটাল সাইনেজ ও প্রজেক্টর। প্রজেক্টরের সাহায্যে কোন মুদ্রা বা নোট সম্পর্কে দর্শনার্থীরা সহজেই বিস্তারিত জানতে পারবেন। এসবের বাইরেও টাকা জাদুঘরে রয়েছে স্যুভেনির শপ, আরো আছে ফুড ক্যাফে।
বৃহস্পতিবার ও সরকারি ছুটির দিন ছাড়া শনি থেকে বুধবার সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে এই টাকা জাদুঘর।
জাদুঘর পুরোটা ঘোরা শেষ হয়ে গেলে কথা হয় টাকা জাদুঘরের কিপার ডঃ আসিয়া খানমের সঙ্গে। প্রথমেই জানতে চাই টাকা জাদুঘরকে জনপ্রিয় করার জন্য কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে কিনা কারণ খোদ মিরপুরেইতো টাকা জাদুঘর অপরিচিত। এ প্রশ্নের জবাবে ডঃ আসিয়া খানম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে পত্র-পত্রিকায় টাকা জাদুঘর সম্পর্কে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এছাড়া কয়েকদিন আগেই মাছরাঙ্গা টেলিভিশনে টাকা জাদুঘরের উপর একটি ডকুমেন্টরি প্রচারিত হয়েছে; এমনকি বাংলাদেশের টেলিভিশনের সংবাদেও কভারেজ পেয়েছে টাকা জাদুঘর। এভাবেই প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে টাকা জাদুঘর এক সময় দেশের সকলের নিকট পরিচিত হয়ে উঠবে এবং এর দর্শনার্থীর সংখ্যাও বাড়বে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। আলাপচারিতার এক ফাঁকে ডঃ আসিয়া খানম তাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথাও জানান। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে টাকা জাদুঘরকে ৩ তলা পর্যন্ত সম্প্রসারিত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া ৩য় আরেকটি গ্যালারিও তৈরি করা হবে এবং অফিস কক্ষও বাড়ানো হবে বলে তিনি জানান।
তাহলে আর দেরি কেন পাঠক? ডঃ আসিয়ার আশা পূরণে এখনই কেন বেড়িয়ে আসছেন না টাকা জাদুঘর থেকে? আমরা মানতে চাই আর না চাই, টাকাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে এই পৃথিবী। আর এই টাকার ইতিহাস, বিবর্তন ও বর্তমানকে স্বাদেশিক ও বৈশ্বিক কাঠামোয় ধারণ করে রেখেছে যে জাদুঘর সেই জাদুঘর যদি একবারের জন্যও আপনি পরিদর্শন না করেন তবে তা নিজের প্রতিই অন্যায় করা হবে।
প্রতিক্ষণ/এডি/সাদিয়া