শোষণ আর বঞ্চনার নীল চাষে বদলেছে নিখিলের ভাগ্য
প্রতিক্ষণ ডটকম:
ইতিহাসের পাতায় নীল চাষ ভাগ্য বদলের গল্পে নয় অত্যাচারের এক নির্মম অধ্যায়ে পরিনত হয়েছিল। ব্রিটিশ আমলের কথা এ দেশে নীল চাষ বলতেই ছিল মানুষের কাছে আতঙ্ক। ইংরেজদের জুলুমে বাধ্য হয়ে ফসলের জমিতে নীল চাষ করতেন কৃষকেরা। দুবেলা দুমুঠো ভাতের আশা জলাঞ্জলি দিয়ে বেনিয়াদের হাতে তাঁরা তুলে দিতেন কাপড় রাঙানোর উপকরণ। অনেক আগেই বহু সংগ্রামের শেষে নীল চাষিদের সেই দুর্দিনের অবসান ঘটেছে।
দিন বদলের এ পর্যায়ে এসে কৃষকেরা এখন নীল চাষ করেন লাভের আশায়। আর তাঁদেরই একজন রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার যুবক নিখিল রায়। তিনি শুধু নীল চাষই করেন না, নীল তৈরির পর তা বিক্রিও করেন। গঙ্গাচড়ায় বাণিজ্যিকভাবে নীল উত্পাদনের পথিকৃত তিনি। তাঁর কারখানায় কাজ করে স্থানীয় অনেক দুস্থ পরিবার খুঁজে পেয়েছে জীবিকার পথ।
২০০৬ সালে এমসিসি বাংলাদেশ নামের একটি দাতা সংস্থার অধীনে নীল তৈরির ওপর প্রশিক্ষণ নেন নিখিল। গ্রামের কিছুসংখ্যক নারীও এ প্রশিক্ষণ নেন। এরপর সংস্থার আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় নীলগাছের পাতা থেকে নীল উত্পাদন শুরু করেন নিখিল।
নিজের দেড় একর জমিতে এখন নীল চাষ করছেন নিখিল। অন্যের জমি থেকেও তিনি নীলের পাতা কিনে নীল তৈরি করেন। বিক্রি করেন ঢাকার বিভিন্ন সুতা ও কাপড় তৈরির কারখানায়। প্রতি কেজি নীল উত্পাদনে শ্রমিকের মজুরিসহ খরচ পড়ে প্রায় এক হাজার টাকা। উত্পাদিত প্রতি কেজি নীল বিক্রি করে তিনি পান দেড় হাজার টাকা। বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে প্রায় ১২ লাখ টাকার নীল উত্পাদন করে বিক্রি করা হয়। এতে লাভ হয় প্রায় তিন লাখ টাকা। মুনাফার টাকা থেকে দুস্থ শ্রমিকদের তিনি সহায়তাও করেন।
রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কের পাশে খলেয়া ইউনিয়নের হরকলি ঠাকুরপাড়া গ্রাম। এখানেই গড়ে উঠেছে নিখিল রায়ের নীল ও অন্যান্য পণ্য তৈরির কারখানা। উপজেলা সদর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে ওই কারখানায় যাওয়ার পথে সড়কের দুই ধারে অনেক নীলক্ষেত চোখে পড়ে। আর নিখিলের পরামর্শ নিয়ে এ সকল ক্ষেতেই অনেক কৃষক চাষ করছেন নীল।
নীল তৈরির পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাইলে নিখিল জানান, প্রথমে নীলগাছের পাতা জোগাড় করা হয়। পাতাগুলো ১২ ঘণ্টা ড্রামের পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। পানির রং হালকা সবুজ হলে তা আরেকটি ড্রামে ঢালা হয়। ৩০ মিনিট ধরে ঝাঁকুনি দেওয়ার পর ড্রামের পানিতে প্রচুর ফেনা হয়। ফেনাসহ পানি ড্রাম থেকে নল বা বালতির সাহায্যে পাতলা কাপড় বিছানো বাঁশের ঝুড়িতে ঢালা হয়।
১০-১২ ঘণ্টার মধ্যে পানি কাপড় ভেদ করে বের হয়ে যায়। তখন কাপড়ের ওপর এক ধরনের তরল তলানি পড়ে। চামচের সাহায্যে তলানি সংগ্রহ করে তা রোদে শুকানো হয়। দুই-তিন দিন রোদে শুকালে এটি কঠিন হয়ে যায়। এই কঠিন জিনিসটি পিষে নীল তৈরি করা হয়। নীলের সঙ্গে হরিতকীর গুঁড়া মেশালে তা সোনালি রং ধারণ করে। কলার মোচা পিষে মেশালে নীলে কালচে আভা পড়ে। প্রতিবছর জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত নীল তৈরি করা হয়।
নিখিল রায় জানান, বিনামূল্যে বীজ বিতরণসহ চাষিদের উদ্বুদ্ধ করার কারণে এলাকায় এখন ব্যাপকভাবে নীল চাষ হচ্ছে। নীলচাষির সংখ্যা এর মধ্যে এক হাজার ছাড়িয়েছে।
প্রতিক্ষণ/এডি/মাসুদ