ভালো নেই আমাদের ভাষা শহীদরা!
তহিদুল ইসলাম (জাবি প্রতিনিধি)
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি! প্রায় অর্ধশতাব্দী আগের কথা। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও যেদিন হায়েনাদের বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়েছিলেন রফিক, শফিক, জব্বাররা। আজকের দিনের মতো হয়তো সেদিনও তারা কলেজে যেতে পারতেন, পারতেন যার যার কর্মস্থলে সহকর্মীদের সাথে আড্ডা দিয়ে সময় কাটিয়ে দিতে। কিন্তু তারা তা করেননি। মায়ের ভাষাকে ভালবাসতেন বলে মৃত্যুর ভয় তাদেরকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে নেমেছিলেন রাজপথে।
‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ধ্বনিতে রাজপথ প্রকম্পিত করেছিলেন। জীবন দিয়ে এনে দিয়েছেন আমাদের মুখের ভাষা বাংলা ভাষা। এ ভাষাই জন্ম দিয়েছে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুলের মত অসংখ্য কবিকে যারা বাংলা ভাষাকে নিয়ে গেছেন বিশ্বমঞ্চে। কিন্তু সেটা তো অতীত।
গতকাল যখন হল থেকে বের হয়ে বিভাগে যাচ্ছিলাম তখন দেশের সবচেয়ে দীর্ঘতম শহীদ মিনারের উপর উল্লাস করতে থাকা কয়েকজনকে দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। কেউ দল বেঁধে সেলফি তুলছে কেউবা জুতা পায়ে মূল বেদীর উপর বসে আড্ডা দিচ্ছে। পাশে লেখা আছে ‘শহীদ মিনারের মূল বেদীতে উঠা নিষেধ’ কিন্তু সেদিকে কারও কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। মনে হচ্ছিল ওরা যেন বেদীর উপর না, বসে আছে শহীদদের তাজা রক্তের উপর।
২১শে ফেব্রুয়ারিতে এখানেই ঘটা করে শ্রদ্ধা জানানো হবে শহীদদের। ফুলে ফুলে ঢাকা পড়ে যাবে শহীদ মিনারের বেদী। কিন্তু ফুল কি পারবে শহীদদের রক্তের উপর থেকে জুতার ছাপ তুলে ফেলতে?
যারা আমাদেরকে মায়ের ভাষা এনে দিয়েছেন আমরা তাদেরকে ভুলে যাচ্ছি, ভুলে যাচ্ছি তাদের অবদানের কথা। তারা শুধু বাংলা ভাষাই এনে দেননি তাদের হাত ধরেই আমরা পেয়েছি আমাদের মহান স্বাধীনতা। আমরা তাদেরকে ভুলে গেলে কী হবে? বিশ্ব তাদেরকে ভুলেনি।
সারা পৃথিবীতে আমরাই একমাত্র জাতি যারা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে। আর এই জাতির মহান আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানিয়ে ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ দিবসটি পালন করছে। বিশ্ব সম্প্রদায় ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানালেও আমরা কি পারছি জাতির সূর্য সন্তানদেরকে উপযুক্ত মর্যাদা দিতে? ভাষা শহীদদের স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে দেশের বিভিন্ন স্থানে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু সেগুলোও যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে না।
অধিকাংশ শহীদ মিনারই জরাজীর্ণ হয়ে আছে। ফেব্রুয়ারি মাস আসলে যেন কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা হয় স্মৃতির মিনার। আবার কোন কোন জায়গায় ফেব্রুয়ারি মাসেও কোন উদ্যোগ দেখা যায় না। বর্তমানে আমাদের শ্রদ্ধা প্রদর্শন শুধুমাত্র একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে ফুল দেয়া কেন্দ্রীক হয়ে গেছে। শহীদরা প্রতিদান চাননি, চাননি ফুলের সম্মান। চেয়েছিলেন তার সন্তানরা যেন মায়ের ভাষায় প্রাণ খুলে কথা বলতে পারে। কিন্তু সেটিও হচ্ছে না। বাংলা এবং বিদেশী ভাষার মিশ্রণে এক ধরণের খিচুড়ি ভাষা এখন যুব সমাজের ফ্যাশন হয়ে দাড়িয়েছে। শুদ্ধ ভাষার চর্চা নেই বললেই চলে। আজকাল ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এই খিচুড়ি ভাষার প্রয়োগ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে হয়তো এক সময় বাংলা ভাষাই বিলীন হয়ে যাবে।
আমার মনে পড়ে; যখন খুব ছোট ছিলাম তখন ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ব্যাপক উৎসাহ নিয়ে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতাম। বাড়ি থেকে স্কুল পর্যন্ত খালি পায়ে যেতাম। জুতা পায়েতো দূরে থাক, কাউকে শহীদ মিনারে বসতে দেখলে শরীরের ভিতর কাঁটা দিয়ে উঠত, দলবেধে তাকে সরিয়ে দিতাম। অনেক সময় ঝগড়া লেগে যেত। সেটা তো বহুদিন আগের কথা। হাটি হাটি পা পা করে বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি, এখন অনেক পরিণত। কিন্তু সেই ছোট্ট বয়সে সবার মাঝে যে উচ্ছাসটা দেখতাম এখন আর তেমন দেখিনা।
আমাদের মন মানসিকতা এত নিচুতে পৌঁছে গেছে যে আমরা আমাদের পূর্বসূরিদের যথাযথ সম্মানটুকুও দিতে পারছি না। শহীদ মিনারকে ব্যবহার করা হচ্ছে জুতা পায়ে সেলফি তোলার জন্য আর অনেক সংগ্রাম করে অর্জিত ভাষার শরীর ছিন্ন করে বিভিন্ন সময় ব্যবহার করা হচ্ছে দেয়া হচ্ছে স্ট্যাটাস। এটা চলতে পারে না, এটা চলতে দেয়া যায় না। চেতনাকে জাগ্রত করতে হবে, শহীদদের স্মৃতির প্রতি যথাযথ সম্মান জানাতে হবে, ভালবাসতে হবে ভাষাকে। তা না হলে যে শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে না।
প্রতিক্ষণ/এডি/এফটি