মিয়ানমারে গণহত্যা: অং সান সুচির বিষয়ে নিরব পশ্চিমা বিশ্ব !!
উখিয়ার নাইক্ষংছড়ি সীমান্তে আশ্রয় নেয়া শামসুল আলম নামের এক রোহিঙ্গা বলেছেন, ‘নিজের ৮০ বছর বয়সী বৃদ্ধ বাবা ও তিন শিশু সন্তানের জবাই হওয়ার ঘটনা বাকী জীবন তিনি কিভাবে বহন করবেন!’ এরকম শামসুল আলম সীমান্তে এখন অসংখ্য। যাদের তাড়া করছে এমনসব স্মৃতি যা কখনও ভোলার নয়, ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়।(সূত্র- কালের কন্ঠ)। রাখাইন রাজ্যের বাতাসে এখন শুধু লাশের গন্ধ। অথচ এই হত্যাযজ্ঞকে বার বার-ই অসত্য বলে উড়িয়ে দিয়েছেন মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচি।
এতসব ঘটনার পরও ওয়াশিংটন, লন্ডন ও বার্লিনের কাছে অং সান সু চি এখনও গণতন্ত্র ও বাকধীনতার পোস্টার গার্ল। মাস কয়েক আগে ব্রিটেন; নোবেলজয়ী এই নেত্রীকে বাকিংহাম প্রাসাদে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাকে ‘ফ্রিডম অব দ্য সিটি অব লন্ডন’ সম্মাননা দেয়। অথচ ঐ সময়েও তার সরকার ও সেনাবাহিনী দেশের পশ্চিমাঞ্চলে অসহায় রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর চরম নিপীড়ন নিপীড়ন, ধর্ষণ ও পাইকারি গণহত্যা চালিয়েছে।
এমনকি মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর নিপীড়নের বিষয়ে অভিযোগ খতিয়ে দেখতে জাতিসংঘকেও অনুমোদন দেননি সুচি। বরং চলমান সংকটের বিষয়ে ‘অপতথ্য’ ছড়ানোর জন্য ‘সন্ত্রাসীদের’দায়ী করেছেন তিনি। তার এমন বক্তব্যের পর থেকে পশ্চিমা বিশ্বও কিছু বলছে না। এটা থেকে নিরব সমর্থনের বিষয়টি সহজেই অনুমেয়!!
তবে এই বিষয়ে মুখ খুলেছেন ব্রিটিশ টেলিগ্রাফ পত্রিকার সাংবাদিক পিটার অ্যালান ওবর্ন। পশ্চিমা বিশ্বকে দ্বিচারী উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বিরোধী পক্ষের কারো বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ পাওয়া মাত্র পশ্চিমা বিশ্ব তাৎক্ষণিক চরম ব্যবস্থা নেন, কিন্তু স্বপক্ষের কেউ একই কাজ করলে তাদের মধ্যে গোরস্থানের নিরবতা নেমে আসে’।
তিনি বলেন, ‘‘গত এপ্রিলে রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিত্তে (সাবেক আকিয়াব) গিয়েছিলাম। পরিস্থিতি দেখে গা গুলাচ্ছিল। মসজিদগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে ক্যাম্পে ঢোকানো হয়েছিল। শহরের অধিবাসীদের এক-তৃতীয়াংশই ছিল মুসলিম। মাত্র কয়েক হাজার অবশিষ্ট আছে, তাও আবার কাঁটাতারের ঘেরাটোপে বন্ধি। মেশিনগান তাক করে রাখা হয়েছে তাদের দিকে। রাজ্যের উত্তরে পরিস্থিতি আরো খারাপ। বিশাল বিশাল এলাকাকে ‘মিলিটারি অপারেশন এরিয়া’ ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রবেশাধিকার নেই; ত্রাণ নিয়ে কেউ যেতে পারে না, মিডিয়া যেতে পারে না। সেখানে যা ঘটছে তার কোনো প্রত্যক্ষ ‘সাক্ষী’ নেই।’’
মনিটরিং গ্রুপ ‘আরাকান প্রজেক্ট’ বলেছে, ‘ঐ গ্রামে পাঁচ ঘণ্টার এক অভিযানে কমপক্ষে ১৩০ জনকে হত্যা করা হয়। গ্রামের লোকদের জড়ো করে পুড়িয়ে মারা হয়। সেনারা বেশ কয়েকজনের মাথা কেটেছে—এ অভিযোগও রয়েছে’।হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে যাওয়া একজন পিটার অ্যালানকে বলেছেন, ‘আমার দুই ভাতিজার মাথা কেটে নেওয়া হয়েছে। একজনের বয়স ছিল ছয় বছর, আরেকজনের ৯ বছর। আমার ভাই বউকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ’
মিয়ানমার সেনাবাহিনী হাজার হাজার নিরস্ত্র-নিরীহ গ্রামবাসীকে বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য করছে। তারপরও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় চুপ করে আছে। এ বিষয়ে মিডিয়া কাভারেজ এত কম যে তাকে হৃদয়বিদারক বলে উল্লেখ করেছেন ব্রিটিশ সাংবাদিক পিটার।
তার মতে, ‘এই নিপীড়ন যদি ভেনিজুয়েলা, ইরান, উত্তর কোরিয়া বা জিম্বাবুয়েতে হতো অথবা সিরিয়ায় আসাদ সরকার করত তাহলে পশ্চিমা সরকারগুলো কী করত? রাষ্ট্রদূতদের তলব করা হতো, অপমানজনকভাবে কূটনীতিকদের দেশে ফেরত পাঠানো হতো, দূতাবাস বন্ধ করে দেওয়া হতো, শায়েস্তা করার জন্য সেনাবাহিনী পাঠানো হতো। আর অবশ্যই অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হতো।
অথচ এর বিপরীতে মিয়ানমারের ওপর থেকে চার বছর আগেই তারা অবরোধ তুলে নিয়েছে। তাহলে অবরোধ কেন আরোপ করা হয়? শক্তিমত্তা প্রদর্শনের জন্য, নাকি পশ্চিমা নীতিনিষ্ঠা দেখানোর জন্য’।
পিটার আরো বলেন, ‘পশ্চিমা বিশ্বের মোড়ল ডোনাল্ড ট্রাম্প চলমান নির্যাতনের ব্যাপারে কিছু করেছেন বলে শুনিনি। আঙ্গেলা মারকেলও কিছু করেননি। টেরেসা মেও কিছু করেননি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রোহিঙ্গা মুসলিমরা ব্রিটেনের পক্ষে জাপানিদের বিরুদ্ধে জঙ্গলে জঙ্গলে যুদ্ধ করেছে, তার পরও মে কিছু করেননি। কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, রাষ্ট্রদূতকে তলবও করা হয়নি’।
অর্থাৎ অসহায় এই রোহিঙ্গা মুসলিমদের পক্ষে কেউ এগিয়ে আসাতো দূরে থাক, বরং নিরব দর্শক হিসেবেই তা উপভোগ করছে !! এখন পর্যন্ত নির্যাতিত এই জনগোষ্ঠীরও কোন প্রতিরোধ গড়ে তোলার খবর পাওয়া যায়নি !! তাহলে এভাবেই কি পড়ে পড়ে মার খেতে খেতে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে রোহিঙ্গারা ???
রাকিব হাসান
লেখক: সাংবাদিক