যৌনকর্মী থেকে সমাজকর্মী!
জহির উদ্দিন মিশু
ব্রেন্ডা মেয়ারস পাওয়েল। জীবনের শুরুতে যিনি বাধ্য হয়েছিলেন যৌনকর্মী হতে। আর দীর্ঘ ২৫ বছর পর সেই জীবন থেকে বেরিয়ে ব্রেন্ডা গড়ে তুলেছেন ‘ড্রিম ক্যাচার’ ফাউন্ডেশন। যেখানে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন সেই সব মেয়েদের ভাগ্যোন্নয়নে, যারা বাধ্য হয় যৌনকর্মকে পেশা হিসেবে নিতে। বিবিসিতে ব্রেন্ডা মেয়ারস পাওয়েল শুনিয়েছেন, যৌনকর্মী থেকে সমাজকর্মী হয়ে ওঠার সেই গল্প।
ব্রেন্ডা মেয়ারস পাওয়েল! ১৯৬০ সালে শিকাগোর পশ্চিমে একটি শহরতলীতে জন্ম। ৬ মাস বয়সেই মাকে হারান তিনি। ব্রেন্ডা বড় হয়েছেন তার দাদির কাছে। তার দাদি প্রচুর নেশা করতেন। প্রায়ই তিনি বার থেকে তার বন্ধুদের বাড়িতে নিয়ে আসতেন। দাদি নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ার পর তার বন্ধুদের দ্বারা ব্রেন্ডাও প্রায়ই শারীরিকজভাবে লাঞ্ছনার শিকার হত। ব্রেন্ডার বয়স তখন সবে চার কী পাঁচ বছর। কিন্তু ব্রেন্ডার দাদি এ ব্যাপারে কিছুই জানতেন না।
ব্রেন্ডা তখন তাদের বাড়ির পাশে ঝলমলে রঙের পোশাক পরে সুন্দর সাজের কিছু নারীদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতেন। ব্রেন্ডা জানতো না তারা সেখানে কী করে। একদিন তিনি তার দাদিকে জিজ্ঞাসা করলে দাদি বলেন ‘মেয়েগুলো তাদের দেহ দিয়ে ব্যবসা করে, বিনিময়ে লোকেরা তাদের টাকা দেয়।’ ব্রেন্ডা মনে মনে ভাবলো তিনিও বোধহয় ওদের মতোই একজন, কারণ ইতোমধ্যেই তিনিও এরকম অবস্থার শিকার হয়েছেন। ব্রেন্ডার বয়স যখন ১৪ তখন থেকেই তার দাদি তাকে বাড়িতে টাকা দিতে বলে, কারণ তখন বাড়িতে খাওয়ার কিছুই ছিল না।
সেদিন ছিল শুক্রবার। সন্ধ্যায় ব্রেন্ডা মার্ক টুইন হোটেলের সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল। সেদিন ব্রেন্ডা চার ডলারের সস্তা টু পিস, একটি প্লাস্টিকের জুতো আর কমলা রঙের লিপিস্টিক দিয়ে সেজেছিলো, যেন তাকে কিছুটা বয়স্ক দেখায়। সেদিন পাঁচজনের সঙ্গে শুয়েছিলো ব্রেন্ডা। ব্রেন্ডার বয়স ছিল মাত্র ১৪। ব্রেন্ডা কিছুই জানতো না। তবে তারা ব্রেন্ডাকে শিখিয়েছিল কীভাবে মানিয়ে নিতে হয়। সেদিন ব্রেন্ডা ৪০০ ডলার আয় করেছিলো। আয়ের অধিকাংশ ডলারই ব্রেন্ডা তার দাদিকে দিয়ে দিয়েছিলো। ডলার দেওয়াতে ব্রেন্ডার দাদি খুবই খুশি হয়েছিল সেদিন। তবে তার দাদি কখনো জানতেও চায়নি, এই ডলার কোথায় পেয়েছিল ব্রেন্ডা।
তৃতীয় বারের মতো ব্রেন্ডা যখন সেখানে গেলো, পিস্তলওয়ালা তিনজন যুবক ব্রেন্ডাকে জোর করে তাদের গাড়িতে তুলে নিয়ে গেল। প্রথমে তারা ব্রেন্ডাকে একটা মাঠে নিয়ে ধর্ষণ করল এবং তারপর একটা হোটেলের ছোট্ট রুমে আটকে রাখল। পরে তারা ব্রেন্ডাকে দিয়ে জোর করে ছয় মাসের মতো যৌন ব্যবসা করিয়েছিল। বিষয়টি যথেষ্ট শারীরিক এবং মানসিক কষ্টের। ব্রেন্ডা বের হতে চাইলেও তারা ব্রেন্ডাকে প্রচন্ড মারধর করত। তারপর তারা ব্রেন্ডাকে আর এক দালালের কাছে বিক্রি করে দেয়। এভাবে ২৫ বছর ব্রেন্ডাকে যৌনদাসী করে রাখা হয়েছিল।ব্রেন্ডা বলেন, ‘‘এই ২৫ বছরে কেউ আমার কাছে কখনো ফুল নিয়ে আসেনি। তারা শুধু আমার শরীরটাকে একটা বাথরুমের মতো ব্যবহার করেছে। তারা এমন ব্যবহার করত, যেন তাদের সমস্ত রাগ ক্ষোভ এই পতিতার উপর।”
১৯৯৭ সালের পয়লা এপ্রিল। ব্রেন্ডার বয়স তখন প্রায় ৪০। এক কাস্টমার সেদিন সন্ধ্যায় ব্রেন্ডাকে তার গাড়ি থেকে ছুড়ে ফেলে দিল। এতে ব্রেন্ডা মারাত্মকভাবে যখম হয়েছিলো। ব্রেন্ডা হাসপাতালে যায় চিকিৎসার জন্য কিন্তু চিকিৎসকরা তার পরিচয় জানার পর তাকে ইমার্জেন্সি রুম থেকে বের করে দেয়। পরে একজন নারী চিকিৎসক ব্রেন্ডার কাছে এসে তাকে সেবা দিলেন এবং ব্রেন্ডাকে একটি মাতৃসদনের ঠিকানা দিয়ে সেখানে যেতে বললেন।
এডুইনা গেটলে নামের এক অসাধারণ ইংরেজ ভদ্র মহিলা ওই মাতৃসদনটা চালাতেন। তিনি ব্রেন্ডাকে সুস্থ করে তুলেছিলেন, বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন এবং ব্রেন্ডার যতদিন ইচ্ছা, সেখানে থাকতে বলেছিলো।সেখানে ব্রেন্ডা শিখেছিলো কীভাবে পারস্পরিক ভালোবাসা এবং সহযোগিতা একটা মানুষকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারে। ব্রেন্ডা বছর দুয়েকের মতো সেখানে থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে শিকাগোর সেই শহরতলীতে ফিরে আসে।
ব্রেন্ডা সেই দুঃসহ জীবন থেকে ফিরে যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। প্রথমে ব্রেন্ডা একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকের কাজে সাহায্য করা শুরু করেন। সুস্থ হয়ে ওঠার তিন বছর পর ড্যানিয়েল উইলসন নামে একজন অসাধারণ মানুষের সঙ্গে পরিচয় হলো ব্রেন্ডার।তিনি ব্রেন্ডার অতীত নিয়ে কখনো কথা বলত না।দারুণ ভালোবাসত ব্রেন্ডাকে।এরপর ব্রেন্ডা এবং উইলসন ‘ড্রিম ক্যাচার’ নামে একটি ফাউন্ডেশন গড়ে তোলে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল যারা যৌনকর্মী হতে বাধ্য হয়েছে, তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা। এখন পর্যন্ত ১৩ জন মেয়েকে তারা দুঃস্বপ্নের পৃথিবী থেকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছে। স্কুল পাস করে এখন বিভিন্ন কলেজে বিনা পয়সায় পড়ালেখার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে তাদেরকে।
সম্প্রতি কিম ল্যাংগিনেটো তাদের সংগঠন ‘ড্রিম ক্যাচার’-কে নিয়ে একটি প্রামাণ্য চিত্র তৈরি করেছেন। তাদের কর্মকাণ্ড সেখানে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এখন ব্রেন্ডার বয়স ৫৮। কিছুদিন আগে ব্রেন্ডা আর উইলসন তাদের দশম বিবাহ বার্ষিকী পালন করে। উইলসন ব্রেন্ডাকে সব সময় সমর্থন করেছে। ব্রেন্ডার মেয়েরা একজন ডাক্তার আর একজন আইনজীবী। ব্রেন্ডা বলেন, ‘‘আমি এখন একজন মা।আমি আপনাদের একটি কথাই বলতে চাই, অনেক ধ্বংস, বাধাবিপত্তির পরও জীবনটা উপভোগের। আমি জীবনের কোনো ক্ষুদ্র অংশের কথা বলছি না, পুরো জীবনটাই উপভোগের। তাই পেছনে না ফিরে আপনার মতো করে জীবনটাকে উপভোগ করুন।’’
সূত্র-বিবিসি থেকে অনুবাদকৃত।