শারমিন আকতার:
অনেক অনেক বছর আগের কথা। বাংলাদেশের সাহিত্যের আকাশে দুই নক্ষত্রের আবির্ভাব হয়েছিল। একজন সৃজনশীল রাজ্যের সিংহাসনে বসে নিত্য নতুন ভাবনার জগতে পরিভ্রমণ করছিলেন। আরেকজন সেই রাজ্যের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকার হয়ে ধীরে ধীরে তাঁরই ছায়ায় বেড়ে উঠছিলেন। রাজার সাথে রাজপুত্রের দেখা হয়নি বহুকাল। এদিকে রাজপুত্র বিভোর রাজার গুণকীর্তনে। গেয়ে চলেছেন তাঁরই গানের কলি। এমনই একদিন কোনো এক পড়ন্ত দুপুরে নির্জন চারিধার। রাজা অধীর আগ্রহে অবাক বিস্ময়ে শুনে চলেছেন তারই লেখা ও সুর করা একেকটি হৃদয়াশ্রিত গান সেই ভাবিকালের রাজার মুখ থেকে…
‘ধনধান্য পুস্প ভরা আমদেরই বসুন্ধরা
তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা’।
এভাবেই চেনা-জানা দুজনকে দুজনার। পিতৃস্নেহে কাছে টেনে নেন পুত্রবৎসলকে। এমনই এক স্নেহমাখা সম্পর্ক বজায় ছিল আমাদের দুই সারথী রবীন্দ্র-নজরুলের মধ্যে। তবুও বাতাসে কেন এত গুঞ্জন এত হলাহল? কারা এই দুজনের অটুট বন্ধনে আলকাত্রার প্রলেপ লাগিয়েছিলেন? আজ সময়ের ব্যবধানে কারো আর অজানা নয় যে, নজরুল রবীন্দ্রনাথের কতটা ভক্ত ছিলেন। আর রবীন্দনাথ কিশোর নজরুলকে কতটা স্নেহ করতেন।
রবীন্দ্র নজরুলের লেখার একটা আলাদা ধরণ ছিল। ছোট্ট একটি গল্পের মধ্য দিয়ে তা তুলে ধরার চেষ্টা করছি –
কোনো এক কিশোরকে তার বাবা আচ্ছামতো পিটাতে শুরু করলো। এমন সময় সেই মেঠো পথ ধরে হাঁটছিলেন ছোটগল্পের জনক রবি ঠাকুর। লোকটি এলোপাথারি পিটিয়েই যাচ্ছে, কোনোদিকে না তাকিয়ে। আর অঝোর ঝারায় কেঁদে চলেছে সেই কিশোর ছেলেটি। রবি ঠাকুর তাকে অনুরোধ করল বাচ্চাটিকে আর না মারার জন্য। কিন্তু লোকটি কি আর শোনে? এভাবে বেশ কয়েকবার অনুরোধ করার পর রবি ঠাকুর বুঝলেন এ এমনই এক গোয়ার গবিন্দ, যাকে পোষ মানানো বেজায় ভার! তিনি নিরুপায় হয়ে মন ভার করে চুপচাপ ফিরে গেলেন সেই পথ ধরে। এরই মধ্যে ঐ একই পথ ধরে এগিয়ে আসছেন বিদ্রোহের অনলে পোড়া এক চির বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল। তিনি বাচ্চাটিকে মারতে দেখে কাল বিলম্ব না করে শটাং করে লোকটির হাত থেকে কিশোরটিকে একরকম জোর করে উদ্ধার করলেন।
আসলে এ নিছকই এক গল্প মাত্র। দুজনের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য বোঝানোর জন্য এ গল্পের আমদানী করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালবাসিলাম সে কখনও করে না বঞ্চনা’। আর নজরুল বলেন, ‘আমি চির-বিদ্রোহী বীর –
আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির’! এই আমাদের দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা। নজরুল কোনো ভুল করলে তৎক্ষণাৎ রবি ঠাকুর তা শুধরে দিতেন। তাঁদের দুজনের মাঝে ছিল পিতা-পুত্রের সম্পর্ক।
নজরুল যখন আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দী তখন নোবেল জয়ী রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখা ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যটি কাজী নজরুল ইসলামকে উৎসর্গ করেন, অনেকের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও। আবার নজরুলও তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা সংকলন ‘সঞ্চিতা’ রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করেন। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নজরুলের লেখা কবিতাগুলো হলো ‘নতুন চাঁদ’ গ্রন্থের ‘অশ্রুপুষ্পাঞ্জলি’ ও ‘কিশোর রবি’ এবং ‘শেষ সওগাত’ গ্রন্থের ‘রবিজন্মতিথি’।
আরেকটি গল্প বলি। এটা নিছক গল্প নয়, সত্যি বটে। নজরুলের সবচেয়ে বড় পরিচয়, তিনি বিদ্রোহী কবি। যদিও তাঁকে সাম্যের কবিও বলা হয়। হঠাৎ করে নজরুল প্রেমের কবিতা লিখতে শুরু করলো, বিদ্রোহের ঝাঁজ বাদ দিয়ে। একেবারে আবেগের রসে টইটুম্বুর। কিন্তু রবি ঠাকুর তাঁর এই পরিবর্তনে বেজায় ক্ষেপেছেন! তিনি ডেকে পাঠালেন তরুণ নজরুলকে। এরপর রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘তুমি যদি ক্ষুর দিয়ে দাড়ি না চেঁছে তলোয়াড় দিয়ে দাড়ি কাটা শুরু করো, তাহলে ব্যাপারটা কেমন হবে? তুমি বিদ্রোহী কবি। ভুলে যেও না, বিদ্রোহের জন্যই তোমার জন্ম। সবাই এ কাজটা করতে পারে না। কিন্তু তুমি তা পারছো। একে ছেড়ে যেও না। এটাই তোমার অস্তিত্বকে বিলীন হতে দেবে না’। এরপর পিতৃতুল্য আদেশকে মাথায় তুলে নিয়ে নজরুল একে একে লিখে গেলেন ইংরেজের বুকে জ্বালা ধরা কবিতা। আর গেয়ে গেছেন মানুষের প্রতি মানুষের সাম্যতার কথা।
‘দেখিনু সেদিন রেলে,
কুলি ব’লে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে!
চোখ ফেটে এল জল,
এমনি ক’রে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?’(কুলি ও মজুর কবিতা)
‘গাহি সাম্যের গান—
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!’(মানুষ কবিতা)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঠিকই বলেছেন, ‘আমি মৃত্যুর চেয়ে বড়
এই শেষ কথা বলে যাবো আমি চলে।’(মৃত্যুঞ্জয় কবিতা)
এক জীবনে এত লিখে গেছেন যার প্রয়োজন এখনও ফুরিয়ে যায়নি। পৃথিবীর ইতিহাসে বাংলা যতদিন বেঁচে থাকবে; স্বগর্বে মাথা উঁচু করে নজরুল-রবীন্দ্রনাথও অমলিন হয়ে থাকবে এ ধরায় মৃত্যুকে তুচ্ছ করে।
========