শিম্পাঞ্জী-বানরের প্রস্তর যুগে প্রবেশ!
প্রত্নতত্ত্ববিদরা পশ্চিম আফ্রিকার ঘনবর্ষণ বনাঞ্চল, ব্রাজিলের বনভূমি এবং থাইল্যান্ডের সমুদ্র উপকূলে পাথুরে হাতিয়ার খুঁজে পেয়েছেন। হাতিয়ারগুলো প্রথম দর্শনে খুব প্রাচীন বলে মনে না হলেও আদতে এগুলো মিশরীয় পিরামিডের সময়কালীন পুরাতন। তবে এই আবিস্কারের বিশেষত্ব হচ্ছে হাতিয়ারগুলোতে মানুষের হাতের ছোয়া পড়েনি। বরং হাতিয়ারগুলো শিম্পাঞ্জি, ক্যাপুচিন (দক্ষিণ আমেরিকার লম্বা লেজওয়ালা বানর) এবং ম্যাকাক বানরেরা ব্যবহার করতো। বিজ্ঞানের নতুন একটি শাখা ‘প্রাইমেট প্রত্নতত্ত্ব’ এর মাধ্যমে এই প্রত্নতাত্ত্বিক আবিস্কার করা হয়েছে।
প্রাচীন মানুষের বানানো প্রস্তর কুঠারের তুলনায় শিম্পাঞ্জি এবং বানরের বানানো প্রস্তর হাতুরি ব্যবহার ও নান্দনিক বিবেচনায় নেহায়েত খেলনা, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই প্রাইমেটরা প্রস্তর ভিত্তিক প্রযুক্তি ব্যবহারের রীতি উন্নয়ন ঘটাচ্ছে। আর এর মানে দাঁড়ায় তারা প্রস্তর যুগে প্রবেশ করছে।
কয়েক দশক আগেও জীববিজ্ঞানীরা মনে করতেন মানুষই একমাত্র প্রজাতি যারা ব্যাপকভাবে কৌশল ব্যবহারে সক্ষম। এখন আর তেমনটি ভাবার কারণ নেই। আমরা জানি অনেক স্তন্যপায়ী, পাখি, মাছ এমনকি কীটপতঙ্গও তাদের জীবনকে সহজ করে তুলতে পরিবেশ থেকে কোন উপকরণ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। অনেক প্রাইমেটও হাতিয়ার ব্যবহার করে। যেমন ২০১৪ সালে দেখা গিয়েছিল বন্য গরিলা গাছের ডাল ব্যবহার করে পিঁপড়াদের ঢিবি থেকে বের করে আনছে। প্রাইমেট প্রত্নতত্ত্ব (Primarch) প্রকল্পের প্রধান এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মিখায়েল হাশলাম বলেন, ওরাং-ওটাং, বোনোবো, এবং গরিলাদের হাতিয়ার হিসেবে গাছের ডাল ব্যবহার করতে দেখলেও এখনো পর্যন্ত পাথরের হাতিয়ার ব্যবহার করতে দেখা যায় নি। যদিও গেরিলা বা শিম্পাঞ্জিরা সুনির্দিষ্টভাবে কেন পাথরের হাতিয়ার কালেভদ্রে ব্যবহার করে তার এখনো রহস্যাবৃত।
এ ব্যাপারে মিখায়েল উল্লেখ করেন, বেশিরভাগ সময় গাছে বাস করা প্রাণীদের কাছে পাথর সহজলভ্য ছিল না, বরং তাদের কাছে গাছই সর্বব্যাপী।
পশ্চিম আফ্রিকার শিম্পাঞ্জিরা তাদের প্রস্তর ভিত্তিক হাতিয়ার বানানোর প্রযুক্তি বংশানুক্রমে বিলিয়ে দিয়েছিল, যা দিয়ে তারা বাদামের শক্ত খোলস ভাঙ্গতে ব্যবহার করতো। মানব প্রত্নতত্ত্বের জ্ঞান টিকে আছে মূলত প্রাচীন মানুষের আচার-ব্যবহার এবং তাদের ব্যবহৃত জিনিসপত্রের ওপর। শিম্পাঞ্জিদের তৈরি প্রাচীন সব হাতিয়ার খোঁজার জন্য জার্মানীতে বিবর্তনীয় প্রত্নতত্ত্ব এর ম্যাক্স-প্লাংক ইনস্টিটিউটের খ্রিস্টোফি বোইসেখ ‘প্রাইমেট আর্কিওলোজিস্ট’ এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তারা আইভরি কোস্টের ঘনবর্ষণ বনাঞ্চলে ভূ-পৃষ্ঠের ১ মিটার নিচে পাথরের তৈরি ৪৩০০ বছর আগের হাতিয়ার খুঁজে পেয়েছেন। হাতিয়ারের অনেকগুলোই এতোটা নিখুঁত যে সেগুলো মানুষের পক্ষেই তৈরি করা সম্ভব। তবে এদের কিছু কিছু আবার খুব ঠুনকো মানের ঠিক যেমনটি বর্তমান সময়ের শিম্পাঞ্জিরা ব্যবহার করছে।
গবেষণায় দেখা গেছে শিম্পাঞ্জিদের এইসকল হাতিয়ার বেছে নেয়ার এবং ব্যবহার করার মধ্যে নিয়মতান্ত্রিক উপায় রয়েছে। যেমন শিম্পাঞ্জিদের হাতুড়ি ব্যবহার করার ক্ষেত্রে দেখা গেছে তারা অপেক্ষাকৃত বড় ও ভারী হাতিয়ারকেই বেছে নেয় যাদের ওজন ১ থেকে ৯ কেজি পর্যন্ত হতে পারে, যখন মানুষ অপেক্ষাকৃত কম ওজনের হাতুড়ি ব্যবহার করে যাদের ওজন ১ কেজির বেশি নয়। ৪৩০০ বছর আগের খুঁজে পাওয়া হাতিয়ারগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই ওজনে ১ কেজির বেশি, যা শিম্পাঞ্জিদের দ্বারাই ব্যবহৃত হতে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া শিম্পাঞ্জিরা এইসব হাতুড়ি এমন কিছু শক্ত খোলস বিশিষ্ট ফল ভাঙ্গার জন্য ব্যবহার করেছে যেগুলো মানুষের খাদ্য নয়। প্রাচীন সেইসব হাতিয়ারের গায়ে লেগে থাকা শর্করা এটিই নির্দেশ করে। এই আবিস্কারের মাধ্যমে ধারণা করা হচ্ছে আইভরি কোস্টের ঘনবর্ষণ বনাঞ্চলে শিম্পাঞ্জিরা কমপক্ষে ৪৩০০ বছর ধরেই হাতিয়ার ব্যবহার করে আসছে।
বোইসেখ এর মতে, শিম্পাঞ্জিদের প্রস্তরযুগ বেশ জলদি শুরু হয়েছে, তবে এর পূর্বের ধাপগুলোর নিদর্শন ঠিক কোথায় পাওয়া যাবে তা বলা কঠিন। শিম্পাঞ্জিরা আমাদের জীবিত নিকটাত্মীয়। শিম্পাঞ্জি ও মানুষের একটি সাধারণ পূর্বপুরুষের মাধ্যমেই প্রথমবারের মতো পাথরের হাতিয়ার তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল। বিবেচ্য হলো পশ্চিম আফ্রিকার শিম্পাঞ্জীরা যখন পূর্ব ও মধ্য আফ্রিকান শিম্পাঞ্জিদের গোত্র থেকে আলাদা হয়েছে তারপর এরা হাতিয়ার তৈরি করা শিখেছে। তবে এটি ঘটেছে ৫ লক্ষ থেকে ১ মিলিয়ন বছর আগে। তাই ধারণা করা হচ্ছে পশ্চিম আফ্রিকার শিম্পাঞ্জিদের প্রস্তর যুগ মানুষের প্রস্তর যুগ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
২০০৪ সালের একটি গবেষণায় দেখো গেছে ব্রাজিলের ক্যাপুচিন (Sapajus libidinosus) বানরেরা কয়েকশত বছর আগে পাথরের হাতিয়ার ব্যবহার করতো। অনুরূপ ২০১৫ সালের একটি গবেষণায় দেখো গেছে থাইল্যান্ডের লম্বা লেজওয়ালা ম্যাকাক বানররাও একইরকম (Macaca fasciwlaris aurea) আচরণ করে। এই দুই প্রজাতির কোনটিই প্রাইমেটের বিবর্তনীয় শাখায় মানুষের কাছাকাছি নয়। ক্যাপুচিনদের নতুন পৃথিবীর বানর বলা হয় যারা আমাদের থেকে ৩৫ মিলিয়ন বছর আগে আলাদা হয়ে যায়, একইভাবে ম্যাকাক বানররাও ২৫ মিলিয়ন বছর আগে আমাদের থেকে আলাদা হয়ে যায়। অন্যদিকে প্রস্তর যুগের প্রাইমেটরা বিবর্তনীয় শাখায় এতোটাই বিস্তৃত ছিল যে প্রতিটি প্রজাতিই অব্যশম্ভাবী নিজেদের মতো করে কৌশল রপ্ত করা শিখে যেত।
বানরের এই উভয় প্রজাতিই হাতিয়ার ব্যবহারের কৌশল প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পৌঁছে দিতে পেরেছে। অর্থাৎ এটা সুস্পষ্ট যে মানুষ ছাড়াও আরও তিনটি প্রজাতির মধ্যে পাথরের হাতিয়ার তৈরি ও ব্যবহারের সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। শিম্পাঞ্জী আর বানরের তৈরি এইসকল হাতিয়ার অপেক্ষাকৃত সরল গঠনের, তেমনি আদিম মানুষের বানানো হাতিয়ারগুলোও একই গঠনের ছিল।
২০১৫ সালের মে মাসে কেনিয়ায় গবেষণারত প্রত্নতত্ত্ববিদরা আমাদের পূর্বপুরুষদের তৈরি প্রাক প্রস্তর হাতিয়ার সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন।এখানে উল্লেখিত ‘Lomekwian’ পাথুরে হাতিয়ারগুলো ৩.৩ মিলিয়ন বছর আগের। প্রত্নতাত্ত্বিক দলটি জানায় এই হাতিয়ারগুলোর সাথে শিম্পাঞ্জি আর বানরের বানানো হাতিয়ারের যথেষ্ট মিল রয়েছে। ফলে এইসব হাতিয়ার তৈরি করা প্রাইমেটদের মাধ্যমে আদিম মানুষের ব্যবহার সম্পর্কে ভালো জানা সম্ভব হবে। যদিও এই ধারণায় দাড়ি টানা খুব একটা সহজ নয়, কারণ শিম্পাঞ্জি ও বানর এবং আদিম মানুষের মাঝে যথেষ্ট ব্যবধান রয়েছে।
‘Lomekwian’ হাতিয়ারের পরবর্তীতে ৭০০,০০০ বছরের মধ্যে মানুষের প্রযুক্তির অনেক পরিবর্তন এসেছে। প্রথমে এসেছে ‘Oldowan’,পাথরের তৈরি তীক্ষ্ণ ধার বিশিষ্ট কুড়াল। এর প্রায় দশ লক্ষ বছর পরে এসেছে ‘Acheuean’ কুড়াল। ধীরে ধীরে আমাদের পূর্বপুরুষরা উন্নত হাতিয়ার বানাতে পারলেও শিম্পাঞ্জি আর বানররা কেন ‘Lomekwian’ পর্যন্তই আটকে থাকলো সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। মানুষের বড় আকারের মস্তিস্ক আর মানুষের চালাক হওয়ার কারণেই হয়তো আমাদের হাতিয়ার বানাতে সাহায্য করেছে। তবে শিম্পাঞ্জি আর বানররা পূর্বের চেয়ে জটিলতর হাতিয়ার বানাতে সক্ষম হলেও তারা কখনোই হাতিয়ার তৈরির ক্ষেত্রে মানুষকে ছাড়িয়ে যেতে পারবে না।
সুত্রঃ ইন্টারনেট
প্রতিক্ষণ/এডি/এনজে