গায়ে কালো ওভারকোটটা জড়িয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে পার্কিং থেকে দোকানের ভেতরে আসতে আসতে জুতোর তলা স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে উঠল মিঃ ভি’র, যার পুরো নাম ভিক্টর আল্ভারাডো। ক্যালিফোর্নিয়ায় ওভারকোট জড়ানোর মত শীত তেমন একটা পরে না তবুও আজ একটু শিরশিরে ঠান্ডা বাতাস কান অবশ করে দিচ্ছে। দোকানে ঢুকে চেয়ার টেনে ওভারকোটটা গা থেকে খুলে চেয়ারে ঝুলিয়ে বসে পড়লেন মিঃ ভি। ভেতরে বেশ উষ্ণ। বসে বসে অপেক্ষা করছেন বন্ধুর পথ চেয়ে। কফির মগ থেকে সুবাসিত ধোয়া তাকে জাগিয়ে তুলছে। তবুও শরীরের আলস্য কাটছে না। মাথাটা ঝুকে আছে টেবিলের দিকে। মনে মনে জীবনের হিসাবের খাতাটা টেনে নিলেন। তার খালি জায়গাগুলোতে নজর বুলিয়ে যাচ্ছেন। কখনও এক পাতা বের করে আনছেন স্মৃতির পরত থেকে আবার সেটা সযতনে গুছিয়ে রেখে দিচ্ছেন অন্য পরতে। সেই সময় টেবিলের উপর কারো ছায়া দেখে মুখ তুলে তাকিয়ে ভি দেখতে পেলেন জেরেমী আসছে। জেরেমীর ছয় ফুটের বেশি লম্বা বিশাল দেহী মানুষ, এখনও শরীরের বাধন বেশ সবল।
ফোর্টি এইটথ স্ট্রীটের শেষ মাথায় গোলাকার চাতালের উপর গ্যাস ল্যাম্প বার এটি। সান ডে নাইটে মানুষের হুল্লোড়ে কান পাতা দায় কিন্তু এখন বারটিকে কপর্দকশূন্য মনে হচ্ছে। আকাশের মেঘ সরিয়ে রোদ উঠল। ওকের পাতার ফাঁকে হলুদ-কমলা রোদ কাঁচের পারদ গলে মেঝেতে এসে ছড়িয়ে যাচ্ছে।
ভি জেরেমীকে জিজ্ঞেস করল, তোমার মনে আছে তোমার সাথে আমার পরিচয় কত বছরের! কত বছর হবে? পয়তাল্লিশ? ছয়চল্লিশ? হ্যাঁ, তা তো হবেই। সেই প্রথম তোমার সাথে আমার পরিচয়। তুমি মেরিন সীল আর আমি উচ্চাকাঙ্খি স্বপ্নের পেছনে ছুটে চলা এক পুলিশ। দূরে পাহারের গা বেয়ে ছাইরঙা মেঘের দিকে নিবদ্ধ তার দৃষ্টি যেন নিজেকেই শোনাচ্ছেন এভাবে বলে যেতে থাকলেন, আমাকে কিউবায় যেতে হল সেবার ডিপ্লম্যাটিক মিশনে। হেলিকপ্টারের হ্যাঙ্গার থেকে নেমে তোমার সাথে সাক্ষাত। দ্বিত্বীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময় সেটা। কিউবা তখন শ্রমিক আন্দোলনে উত্তাল। মহান বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রোর এক সমাবেশে থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার সেই সময়। মুক্তিকামী মানুষের হাতে মুক্তির পিদীম জালিয়েছেন এই বিপ্লবী নেতা। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ঘরে ঘরে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান জানিয়েছে তিনি। মানুষের অন্তরে জালিয়েছেন আশার আলো। হাতিয়ার তুলে নিয়েছে সাধারন শ্রমিক আর দিনমজুর তাদের শরীরের নোনা ঘাম আর রক্তের বিনিময়ে গড়া দেশে তাদেরই অধিকার সুরক্ষার করার জন্য। আর অপ্রতিরোধ্য শক্তি এবং সাহসের আলোকবর্তিকাটি নিয়ে পথ দেখিয়ে চলেছিলেন যে ব্যাক্তি তিনি আর কেউ নন তিনি হচ্ছেন ফিদেল ক্যাস্ট্রো। তাঁর নাম কখনো ইতিহাসের পাতায় অমলিন থাকবে তাঁর কীর্তির স্বাক্ষী হয়ে। সেই সময় শহরের অলিতে-গলিতে লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল ক্যাস্ট্রোর নাম। মানুষ শান্তির বারতা বাহককে দেখার জন্য দুর-দুরান্ত হতে ছুটে আসত। সকলের কাছে ক্যাস্ট্রো তখন এক অলৌকিক ক্ষমতাধরের নাম যে স্বৈরাচার শ্বাসন ও শোষনের বিরুদ্ধে সোচ্চার জনমানুষের নেতা যে কিনা স্বাধীনতার সূর্য ক্যারিবিয়ান সাগরের ওপার থেকে ছিনিয়ে আনতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। ঘরে ঘরে গড়ে তুলেছিলেন প্রতিরোধের দূর্গ মুখে দিছিলেন প্রতিবাদের ভাষা আর অন্তরে জেলেছিলেন বিপ্লবের আগুন। সেই উত্তপ্ত সময়ে আমার প্রবেশ সেই শহরে। তখন আমি স্পেশাল ব্রাঞ্চের লোক। সেটা গোপন রইল। গোপন রইল আমার মিশনের কথাও।
হলোকাস্টের ঠিক পরের বছর ছিল সেটা। জার্মান নাতসীদের ইহুদীদের সাথে কয়েক হাজার কিউবান শ্রমিক এবং সৈনিককে মারা হয়েছে গ্যাস চেম্বারে। ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলে যাচ্ছেন তাঁর ভাষনে উত্তাল জনতার মাঝে, “আজ বিকেলে আমরা যাঁরা দেশ মাতৃকার জন্য প্রাণ উতসর্গ করেছিল তাঁদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধার্ঘ অর্পন করতে এসেছি। আর যারা যুদ্ধে যেতে পারেননি যাঁরা আজ পিতৃভূমি (কিউবানদের ভাষায়) কে বাঁচাতে কাজ করে যাচ্ছেন তাদের অভিনন্দন জানাই। যারা জীবন বাজি রেখে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে তাদেরকে অভিনন্দন জানাই। সংগ্রামী সালাম জানাই যে বন্ধুগণ অস্ত্র কাঁধে নিয়ে হেটেছেন মাইলের পর মাইল। সালাম জানাই সেই সব বিপ্লবী সেনাদের যারা দেশের একতা রক্ষায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। অন্তরে প্রোথিত ক্যাস্ট্রোর বিপ্লবী ভাষন যখন মিঃ ভি’র মুখ থেকে বেরিয়ে আসছিল জেরেমীর কাছে মনে হল সে স্বয়ং ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সামনে বসে আছে। জেরেমী তাকিয়েছিল ভি’র দিকে। ভি থেমে যাওয়ায় সে প্রশ্ন করার সুযোগ পেল, বলল, তুমি মার্ক্সবাদীদের মত কথা বলছ। তুমি কি হলফ করে বলতে পার যে সেই সময় তুমি ঠিক আমেরিকার জন্যই কাজ করেছিলে?
ভিঃ আমি কখনও দেশের বিরুদ্ধে বেইমানী করিনি।
জেরেমীঃ তবে তোমার কথা সুর আজ অন্যরকম লাগছে।
ভিঃ আসলে আমার খুব শুনতে ভাল লাগত ফিদেল ক্যাস্ট্রোর খুন জাগানিয়া বক্তৃতা। মনে হত স্তবকের পর স্তবক পবিত্র কবিতা পাঠ করে যাচ্ছে্ন উনি। সে কবিতা জনমানুষের কবিতা, মানুষের অধিকার আদায়ের কবিতা, সংগ্রামের কবিতা, মানুষের মনের কথা, হৃদয়ের কথা । আবারও নিজেকে শোনানোর মত মৃদু স্বরে বলে যাচ্ছিল ভি মুখস্থ করা ক্যাস্ট্রোর ভাষন, “যখন স্বৈর শাসকের বর্বর অত্যাচারের সকলের সামনে উন্মোচিত হল, আমাদের সংগ্রামের ফসল হিসাবে অপরাধীদের নাশকতার কাহিনী বেরিয়ে এল সকলের সামনে তখন শত্রুরা যে কোন মূল্যে এ বিপ্লব ঠেকাতে মরিয়া হয়ে উঠল। তাদের কাছে বিপ্লবের মূল্য আরো বেড়ে গেল। তাদের নীল নক্সায় যুক্ত হল বিপ্লবীদের মূল্য যাই হোক না কেন যদি তাদের পরাজিত করা যায় তবে বিপ্লবের মূল্য আরো বেড়ে যাবে। এ বিপ্লব ঠেকাতে রক্তে রঞ্জিত হবে এ শহর। আজ বিকেলে একজন সাধারন মানুষ দাঁড়িয়েছে শ্রেণী শোষনের বিরুদ্ধে, সাধারন মানুষের অধিকার আদায়ের দাবী নিয়ে।“ ১৯৪৬ এর মার্চ মাসের ধূসর বিকেলে আমি ছিলাম সেই মার্চ মাসের ধূসর বিকেলের। প্রচুর করতালি, সংবর্ধনার মধ্য দিয়ে শেষ হল সেদিনের মিটিং। বিকেল গড়িয়ে রাত হল। রাস্তা আস্তে আস্তে ফাঁকা হল। কয়েক লেন হেটে পাড় হয়ে একটা বারে ঢুকেছি। বারে ঢুকে এক কোণার টেবিলে বসলাম। আমার কয়েক টেবিল পরে দেখলাম বসে আছে ফিদেল ক্যাস্ট্র সাথে তার দলের লোকজন। আমি সচকিত হয়ে উঠলাম। এটাই আমার মোক্ষম সময়। এ সময়ের জন্যই আমাকে এত দূরের পাড়ি দিয়ে আসতে হয়েছে। আজ আমার মনোবাসনা পূরনের দিন। আমার থেকে মাত্র দুই টেবিল দূরে। নিজেদের কথাবার্তায় মশগুল। চারদিকে খেয়ালও করছে না। আমি স্প্যানিশ চর্চা করে এসেছি ঠিকমত। আমি শুনতে পারছি ওরা কিছুদিন পরে মেক্সিকো যাবে। তারপর সেখানে সাথে বিপ্লবের পরিকল্পনা পাকাপোক্ত করে ফিরে আসবে এই শহরে এবং এরপর মূল পরিকল্পনায় হাত দিবে। বাহ!সব তথ্য এখন আমার হাতে। দেশে ফিরে গিয়ে প্রমোশন। আমার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের খসড়া তৈরী। কিন্তু “অদ্ভূত”! তাদের কথাবার্তায় মাঝে মাঝে বিরতি টানতে হচ্ছিল। গ্রাম থেকে আসা সাধারন মানুষ তাদের প্রিয় নেতার সংগে সাক্ষাত করতে আসছিল কিছুক্ষন পর পর। গরীব মানুষরা এক এক করে আসছিল টুকিটাকি কথাবার্তার পর শুভেচ্ছা বিনিময় করে কমরেডের সাথে হাত মিলিয়ে হাতের উলটো পিঠে চুমু খেয়ে চলে যাচ্ছিল। কমরেডের মুখে একবারের জন্যও বিরক্তির রেখা দেখা যায়নি। কমরেড চুরুটে টান দিতে দিতে অবলীলাক্রমে মাস্টার প্ল্যান করে যাচ্ছিলেন। জীবনে অনেক জায়গায় কাজ করেছি। কয়েক বছর কাজ সিক্রেট সার্ভিসে কাজ করেছি কিন্তু এই জীবনে এরকম নেতার দেখা এখনও পাইনি। তিনি ছিলেন জনগনের নেতা, সাধারন মানুষের নেতা। সবার মাঝে থেকে সবার জন্য কাজ করে গিয়েছেন। কোন বিশেষ গার্ডের ব্যাবস্থা ছিল না। গাড়ি-জুড়ির বহর ছিল না। অস্ত্রধারী প্রহরীও ছিল না। সাধারন মানুষ বুক দিয়ে আগলে রেখেছিল তাঁকে। জেরেমি এতক্ষন বাক্রুদ্ধ হয়ে ছিল। হাঠাত ভি কে থামিয়ে দিয়ে বলল, এরপর তুমি পালিয়ে এলে। সবাইকে ভয়ঙ্কর গল্প শোনালে পালিয়ে বেঁচে আসার। তোমার বিশ্বাসঘাতকতার কথা আজ সবাই জেনে গেলে তোমার শাস্তি কত ভয়ানক হতে পারে তুমি কি জানো?
ভিঃ আমি রিটায়ার করেছি কয়েক বছর আগে। এখন আমার কোন দায়বদ্ধতা নেই।
জেরেমি হতাশা, রাগে, ক্ষোভে ফেটে পড়তে চাইছে কিন্তু ভি তাকে থামিয়ে দিয়ে উঠে পড়ল। আরেকবার কফি নিয়ে বেরিয়ে এল বারের পার্কিং এ। কালো সেডানের এঞ্জিন চালু দিল। চারদিকে প্রগাঢ সন্ধ্যা নেমে গেছে কখন টের পাওয়া যায়নি। পনের মিনিটের পথ বাড়ি। গাড়ি চালাতে চালাতে রেড লাইটে এসে এক চুমুক কফি মুখে নিয়ে পাশের গাড়ির ঝাকড়া চুলের ছেলেটার দিকে তাকাল। লাল বাতি সবুজ হল সে গাড়ি চালাতে শুরু করবে ঠিক সেই মূহুর্তে তার বা পাশের একটা গাড়ি থেকে পর পর গুলি ছোড়া হল তার দিকে তাক করে। প্রথম গুলিটা এড়ানো সম্ভব হল কিন্তু পরের গুলিটা উইন্ডশীল্ড ভেদ করে বুকে এসে বিধল। সে এক মূহুর্তের জন্য তার এক প্রিয় মুখ দেখতে পেল। একটা গাড়ি প্রচন্ড স্পীডে তাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। বুকের পাজর ভেদ করে শুন্যে বেরিয়ে গেল এক হাজার শান্তির পায়রা। চোখে হাজার তারা জলে উঠে নিভে গেল সব এক সংগে।
এর পরের গল্প ভি’র জানার কথা নয়। কেউ এম্বুলেন্স ডেকেছিল। খুব দ্রুত তাকে হসপিটালে নেয়া হয়েছিল। মারা যাওয়ার আগে একটা নাম বলতে পেরেছিল সে। নিউজ পেপারে হেডলাইনে লেখা হয়েছিল, “ একজন সৎ উচ্চ পদস্থ পুলিশের কর্মকর্তা—————।“ খুনীকে পাওয়া গিয়েছিল খুব কাছাকাছি। সে পালায়নি কোথাও। তবে সব শেষ হয়ে যায়নি। রাতের রাস্তায় হাওয়ায় ওক পাতাদের সিম্ফনীর আওয়াজ এখনও শোনা যায় গ্যাস ল্যাম্প বারের উঠোনে, হাওয়ায় ভেসে বেড়ায় ভি এর শেষ কথাগুলি যার জন্য তাকে প্রান বিসর্জন দিতে হল। রাস্তার ট্রাফিক, সন্ধ্যা, রাতের আঁধার, রবিবারে বারের আড্ডা, কফি, বৃষ্টি, বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া গাড়ি সব নিত্যদিনের মতই চলছিল। হাইওয়েতে গাড়ির একটানা শব্দ, পুলিশের আনাগোনা, নাগরিক আনন্দ, স্কুল-কলেজের ছেলেদের চিতকার, নেতাদের বক্তৃতা – সব সব সবকিছু একেবারে ঠিকঠাক ছিল।
ফাতেমা খান
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী, লেখক