সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গুরুত্ত্ব

প্রকাশঃ জানুয়ারি ১৪, ২০১৫ সময়ঃ ৮:১৫ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ৯:৫৩ অপরাহ্ণ

fd968d97159acc44679cc6f8fe85b130সম্প্রদায়-গোষ্ঠিগত শ্রেষ্ঠত্ব ও আধিপত্য বজায় রাখার মাধ্যমে তৎকালীন জাহিলিয়া যুগে আরব সমাজে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছিল।

মানুষ শক্তিধরদের দাপটে ছিল অতিষ্ট, ন্যুনতম মানবতাবোধ ছিলনা তাদের মধ্যে। অত্যাচার আর নির্যাতনের চরম ষ্টিম রুরালে নিষ্পেষিত হয়ে মজলুমের জবান আটকে গিয়েছিল।

সেই চরম ও বিভৎস্যকর মুহূর্তে বিশ্ব মানবতার অগ্রদূত মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) আবির্ভূত হন পৃথিবীতে। নবুওত প্রাপ্তির আগেই তিনি আল্লাহর অনুগ্রহে মানুষের হূদয়ে উন্নত ও ন্যায়-নীতি সম্পৃক্ত চরিত্রের মাধ্যমে স্থান করে নেন।

আর নবুয়ত প্রাপ্তির পর শান্তি-সমপ্রীতি ও মানবতার ধর্ম ইসলামের সুমহান বাণী প্রচারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করলেন পারিবারিক, সামাজিক ও সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি এবং একটি আদর্শ জাতি হিসাবে দাঁড় করালেন মানব জাতিকে।

আজকে আমরা ইসলামের সেই সুমহান শিক্ষা ও নবীর (স.) আদর্শচ্যুৎ হয়ে পড়েছি। আমাদের অন্তর, মুখের ভাষা ও কর্ম-এ তিনের মধ্যে কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায়না। আমাদের অন্তর হিংসা ও বিদ্বেষে ভরা, মুখে চাতুর্যপূর্ণ বাক্য সম্ভার আর কর্মে ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত ও সম্পর্ক বিনষ্টকারী ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের কসরত।

এহেন অনিষ্টকর পথ থেকে ফিরে আসতে ইসলামে মানুষকে হুশিয়ার করে দিয়ে বলা হয়েছে, ‘বস্তুত ফেতœা-ফাসাদ বা দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করা হত্যার চেয়েও কঠিন অপরাধ’ (সূরা বাকারা-১৯১)। ‘পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করোনা’ (সূরা আরাফ-৫৬)। ‘তোমাদের কেউ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য ঐ বস্তু ভালবাসে, যা সে নিজের জন্য ভালবাসে’ (বুখারী, মুসলিম; মিশকাত হা/৪৯৬১)।

সমপ্রীতির মাধ্যমে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা গড়ার তাগিদ দেয়া হয়েছে উপরোক্ত বাণীতে। যারা ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা তথা সমপ্রীতির বন্ধন চায়না তাদের (মুনাফিকদের) পরিচয় তুলে ধরে অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘যদি তোমাদের কোন কল্যাণ স্পর্শ করে, তাতে তারা অসন্তুষ্ট হয়। আর যদি তোমাদের কোন অকল্যাণ হয়, তাতে তারা আনন্দিত হয়’ (সূরা আল-ইমরান-১২০)।

উপরোক্ত হুশিয়ার বাণী সম্পর্কে আমরা কতটুকু যতœবান। বর্তমান সময়ের ঘটমান চালচিত্র দেখে আমরা কি ভাবছি। এসব দৃশ্য আমাদেরকে এ কথা জানান দিচ্ছে যে, আমরা পরস্পরের মধ্যে ন্যুনতম ভালবাসা, মমত্ববোধ, সহনশীলতা, পরমত-সহিষ্ণুতা হারিয়ে ফেলেছি; কথায় মাধুর্যতা-শালীনতা বিবর্জিত হতে চলেছি।

ধর্মীয় অনুভূতি ও মানবীয় গুণাবলী আজ মানুষের মধ্যে পাওয়া দুস্কর হয়ে পড়েছে। সমাজে যা কিছু বিদ্যমান তার অধিকাংশ ব্যক্তি স্বার্থ, দলীয় স্বার্থ আর বিধর্মীয় কৃষ্টি-কালচার নির্ভর হয়ে পড়েছে। অথচ আমাদের চরিত্র গঠনে রাসূলুল্লাহ (স.) এর সতর্কবাণী হলো, ‘যে আল্লাহর জন্য অপরকে ভালবাসে ও আ্ল্লাহর জন্য বিদ্বেষ করে, আল্লাহর জন্য দান করে ও আল্লাহর জন্য বিরত থাকে, সে তার ঈমানকে পূর্ণ করল’ (আবু দাউদ হা/৪৬৮১, তিরমিযী হা/২৫২১; মিশকাত হা/৩০)।

ঈমানদার হয়েই ভাল মানুষ হওয়া যায়, চরিত্রবান হওয়া যায়, কর্মকাণ্ডে খারাবি দূর করা যায়। কথায় নয় কাজের মাধ্যমে আমাদেরকে ভাল মানুষ হতে হবে। কিন্তু আমরা কথায় বিশ্বাসী, কাজের মূল্যায়ন কমই হয়ে থাকে আমাদের সমাজে।

এজন্য এ সমাজ ইসলামী সমাজ হতে অনেক দূরে অবস্থান করছে। এহেন সমাজে সামাজিক বন্ধন, সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি, পারস্পরিক সহমর্মিতার অভাব থাকবে এটি বাঞ্চণীয়। একদা রাসুলুল্লাহ (স.)-কে প্রশ্ন করা হলো, শ্রেষ্ঠ মানুষ কে তিনি বললেন, ‘প্রত্যেক শুদ্ধহূদয় ও সত্যভাষী ব্যক্তি’। লোকেরা বলল, সত্যভাষীকে আমরা চিনতে পারি কিন্তু শুদ্ধহূদয় ব্যক্তিকে আমরা কিভাবে চিনব জবাবে তিনি বললেন, ‘যে হবে আল্লাহভীরু ও পরিচ্ছন্ন হূদয়; যাতে কোন পাপ নেই, সত্যবিমুখতা নেই, বিদ্বেষ নেই, হিংসা নেই’। (ইবনু মাজাহ হা/২১৬; মিশকাত হা/২২১)।

ভালমানুষ ব্যতীত ভাল সমাজ গড়া সম্ভব নয়। ভালমানুষের দু’টি গুণ, শুদ্ধহূদয় ও সত্যভাষী হওয়া। কিন্তু এমন ভালমানুষ আমরা হতে পেরেছি কি অথবা ভালমানুষকে মাথা উচু করে দাঁড়ানোর সুযোগ দিচ্ছি কি না, বরং মন্দ মানুষেরা দল বেধে ভালকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে শিয়ালের ‘হুক্কা হু’ ডাকের ন্যায় চিৎকার করে ফিরছে। মন্দ দিয়ে ভাল আশা করা যায়না।

আমরা কয়েক দশক আগেও মানুষের মধ্যে যে হূদ্যতা, সহমর্মিতা, সমপ্রীতি, শ্রদ্ধাবোধ দেখে এসেছি, এখন তার অনেক ঘাটতি হয়ে গেছে। যদিও দু’একটি ঘটনা এখনো আমাদেরকে উৎসাহিত করে।

অতি সমপ্রতি সাভার ট্রাজেডীর উদ্ধার পর্বের শেষ পর্যায়ে ১৭ দিন পরে গার্মেন্টস কর্মী রেশমাকে উদ্ধারের সময় উদ্ধারকর্মীদের প্রানান্তকর প্রচেষ্টা, বাইরে উৎসুক মানুষের একটি প্রাণের জীবিত উদ্ধারের জন্য আল্লাহর দরবারে অভূতপূর্ব আকুতি, উদ্ধার শেষে মানুষের মনে অজস্র স্বত্বি ও মহামূল্যবান কিছু প্রাপ্তির অভিব্যক্তি প্রমাণ করে মানুষ ভাল হলে পরিবেশে পরিবর্তন ঘটে।

অথচ সম-সাময়িক সময়ে একই ঢাকায় হত্যা, নির্যাতন, সংঘর্ষ, আগুনের ছড়াছড়ি যেন বেমানান মনে হয়েছে। শুধু কি তাই, কথার ফুলঝুরিতে একে অন্যের বিরুদ্ধে লাগামহীন বিষোদগার গোটা পরিবেশকে কালিমাযুক্ত ও বিভৎস্য করে তুলেছে। চলছে চরিত্র হনন ও ঘটনা নিয়ে লুকোচুরি কারবার। এভাবে সমাজে-রাষ্ট্রে শান্তি আসতে পারে না।

সমপ্রীতি বজায় রাখা যায়না। সামাজিক ও সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি গড়তে প্রয়োজন ইসলামী জীবন ব্যবস্থার বাস্তবায়ন। মহামানব রসূল (স.) এর আদর্শকে সামনে রেখে সমাজ বিনির্মাণ করা। যিনি মক্কা বিজয়ের দিন বিজয়ীবেশে মক্কায় প্রবেশ করলে কুরাইশদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছিল।

কিন্তু মহানবী (স.) পরাজিত শত্রুদের প্রতি কোন দুর্ব্যবহার করেননি এবং প্রতিশোধ স্পৃহাও প্রকাশ করেননি, বরং ক্ষমা ঘোষণা করে বলেছিলেন, আমি তোমাদের সাথে সেই কথাই বলছি, যে কথা হযরত ইউসুফ (আ) তাঁর ভাইদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন- ‘আজ তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই।

যাও তোমরা সকলেই মুক্ত।’ (আর-রাহীকুল মাখতুম)। প্রতিশোধ দিয়ে বিজয়ী হওয়া যায় না। সংশোধনের সুযোগ দানের মাধ্যমে কর্মে পরিবর্তন আনায় রয়েছে বিজয়। শাস্তি দিয়েই কেবল প্রতিকার সম্ভব নয়, বরং সংশোধনের পথ ধরিয়ে দিয়ে সংশোধন করানো উচিৎ।

রাসূলুল্লাহ (স.) এর বাণী, ‘এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তাকে যুলুম করে না, লজ্জিত করে না, নিকৃষ্ট ভাবে না। তাকওয়া এখানে, তাকওয়া এখানে, তাকওয়া এখানে বলে তিনি নিজের বুকের দিকে তিনবার ইশারা করেন।

অতঃপর বলেন, মানুষের মন্দ হওয়ার জন্য এতটুকু যথেষ্ট যে, সে তার অন্য মুসলিম ভাইকে নিকৃষ্ট ভাবে। মনে রেখ এক মুসলিমের ওপর অপর মুসলিমের জন্য হারাম হল তার রক্ত, তার মাল ও তার ইজ্জত’ (মুসলিম হা/২৫৬৪; মিশকাত হা/ ৪৯৫৯)। -লেখক :ব্যাংকার

তথ্য সুত্রঃইত্তেফাক

প্রতিক্ষন/এডি/হানিফ

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G