হামলাকারীরা কেন ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থী?
শারমিন আকতার:
গত শুক্রবার হলি আর্টিজান বেকারী রেস্তোরাঁয় ঘটে যাওয়া আকস্মিক দু:ঘটনার পর মনের ভেতর কিছু প্রশ্ন বারবার আঘাত করছে। মন বলছে, কেন এমন হল? কিছুটা উত্তরও পেয়েছি। কিন্তু সমাধানতো হল না। এ হামলার সাথে জড়িত ছেলেগুলো ইংরেজি মাধ্যমে পড়ালেখা করেছে। সেখানকার পড়ালেখার ধরণ সসম্পর্কে আমার ভালোই জানশোনা আছে। তারা যদি কোনো বিষয়ে সবচেয়ে কম জেনে থাকে এবং ভুল জেনে থাকে, তা হল নিজের দেশ, ভাষা, সংস্কৃতি আর নিজের ধর্ম। কেউ তাদের শোধরানোর চেষ্টাও করে না। বিলাসিতার মাঝে ডুব দিয়ে বসবাস করাই তাদের একমাত্র কর্ম। এভাভেই কাটে জীবন তারপর সব শেষ। এরা জানেও না কোনো ধর্ম সম্পর্কে। তা সে ইসলাম হোক বা অন্য কোনো ধর্ম। কোনো ধর্মীয় শিক্ষা এসব স্কুলে একেবারেই দেওয়া হয় না। শুধু শেখানো হয় ইংরেজি বুলি! আর কীভাবে ইংরেজদের মতো হওয়া যায় সে শিক্ষাটাই প্রাণপণ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়!
ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে:
১. কোনো ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হয় না
২. ধর্মীয় বই পড়ানো হয় না
৩. ব্যস্ত পরিবারের সদস্য থেকেও পায় না কোনো নৈতিকতার শিক্ষা
৪. ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে শুধু ইংরেজি ভাষা আর তাদের সংস্কৃতিটাই শেখে
৫. এসব স্কুলে পড়ে তারা ইংরেজদের মতো করে কথা বলতে চায়, পোশাক পড়তে চায়, এমনকি আচার আচরণ পর্যন্ত হুবহু অনুকরণ করে চলে।
ফলাফল:
এই ইংরেজি মাধ্যমের ছেলে মেয়েরা না পারছে ইংরেজ হতে; না পারছে মনেপ্রাণে বাংলাদেশী হতে। শেষ পর্যন্ত তাদের অবস্থা হয় দোদুল্যমান। অন্তরের ভেতর নিজের অজান্তে লুকিয়ে থাকে বাংলাদেশের জন্য অকৃত্রিম ভালবাসা আর বাহিরে ইংরেজি বুলি।
পরিণতি:
এই ইংরেজি পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের বিপথে নেওয়া খুব সহজ। কারণ তাদের কাছে দেশীয় কোনো বিষয় যেমন অজানা থাকে তেমনি ধর্মীয় বিষয়েও তারা অজ্ঞ থাকে। তাদের ধ্যানজ্ঞান হয় শুধু পশ্চিমামুখী। আর আরাম-আয়েশ-ভোগবিলাশী টাইপ মনোভাব।
এবার আসুন গত শুক্রবার ঘটে যাওয়া নৃশংস দু:ঘটনার দিকে একটু নজর দিই। ইতোমধ্যে ফেইসবুকের বদৌলতে আমরা জেনে গেছি হামলাকারীদের ব্যক্তিগত পরিচয়। এদের প্রায় প্রত্যেকেই ইংরেজি মাধ্যম থেকে পড়া শেষ করেছে।
প্রশ্ন:
১. কেন ইংরেজি মাধ্যমে পড়ুয়া ছেলেরা জঙ্গীর খাতায় নাম লেখালো?
২. কেন তারা এতটা নৃসংশ আচরণ করল?
৩. এত কম বয়সী তরুণরা কেন এ বিপথে পা বাড়ালো?
৪. কে বা কারা তাদের এ ভুল পরামর্শ দিল?
৫. ইংরেজি মাধ্যম নিয়ে সরকারের আলাদা করে ভাবার কি সময় এখনও আসেনি?
৬. এসব স্কুলে ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের ব্যবস্থা করলে কি ভালো হতো না?
৭. ধর্মীয় জ্ঞানের অভাব ছিল বলেই কি তাদের ভুল পথে পাঠানো সহজ হয়েছে?
ইংরেজি মাধ্যমে আমি অনেকদিন পড়িয়েছি। তাই এর ভুলগুলো আমার চোখে বেশ স্পষ্ট। তবে শিক্ষক চাইলেই কতকিছু করতে পারে, তা আমি নিজেকে দেখে বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারি। আমি যাদের পড়িয়েছি; তাদেরকে সবধরণের শিক্ষা এবং বাস্তব সত্যটা বোঝানোর সবসময় চেষ্টা করে গিয়েছিলাম। এতে আমাদের সংস্কৃতি, দেশাত্ববোধ, মুক্তিযুদ্ধ, ধর্মীয় মূল্যবোধ ছিল উল্লেখযোগ্য। স্কুলের নিয়মের বাইরে গিয়েই এসব কাজ করেছিলাম। এতে বাচ্চাদের মানসিক পরিবর্তনও হয়েছিল চোখে পড়ার মতো। সত্য-মিথ্যাকে তারা বেশ বুঝতে শুরু করেছিল। তাই ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষক এবং পরিচালক, সবার কাছে অনুরোধ;
এসব ছেলে মেয়েদের ইংরেজ বানানোর মিথ্যা স্বপ্ন দেখানো বন্ধ করুন। নিরেট সত্য যা তাই শেখান। বাংলা আমার মায়ের ভাষা। তাই এ ভাষা নিয়ে কোনো ছেলেখেলা করবেন না। প্রথমে তাদের বাংলা শেখান। বাংলার গুরুত্বটা যে কত বেশি সেটা বোঝান। এরপর বিদেশী ভাষার কথা। ইংরেজি আমাদের অবশ্যই জানতে হবে। তবে তা নিতান্ত প্রয়োজনের খাতিরে। এ কথাটি তাদের পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিন। বাংলাকে টপকানোর কোনো দু:সাহস ইংরেজি বা অন্য কোনো বিদেশী ভাষা কখনই দেখাতে পারে না। যদিও এ সত্যটা ভুলে গেছে আমাদের প্রিয় অভিভাবকরা এবং স্কুল পরিচালনাকারীরা। তাই আজ আমাদের এ চরম বিপদের মুখোমুখি হতে হয়েছে। ইংরেজি মাধ্যমের ছেলেদের খ্যাপাটে জঙ্গী হয়ে উঠার বিভৎস চিত্র দেখতে হচ্ছে।
দয়া করে আপনারা এখনই ভেবে দেখুন, যদি এ ছেলেগুলোর প্রকৃত ধর্মীয় জ্ঞান থাকতো তাহলে কি এভাবে নৃসংশ হত্যাযজ্ঞ তারা চালাতে পারতো? যেখানে কোরান (সূরা আল-মায়েদা) বলছে,
مِنْ أَجْلِ ذَٰلِكَ كَتَبْنَا عَلَىٰ بَنِي إِسْرَائِيلَ أَنَّهُ مَنْ قَتَلَ نَفْسًا بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٍ فِي الْأَرْضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِيعًا وَمَنْ أَحْيَاهَا فَكَأَنَّمَا أَحْيَا النَّاسَ جَمِيعًا ۚ وَلَقَدْ جَاءَتْهُمْ رُسُلُنَا بِالْبَيِّنَاتِ ثُمَّ إِنَّ كَثِيرًا مِنْهُمْ بَعْدَ ذَٰلِكَ فِي الْأَرْضِ لَمُسْرِفُونَ
(৩২) ‘এ কারণেই বনী ইস্রাঈলের প্রতি এ বিধান দিলাম যে, যে ব্যক্তি নরহত্যা অথবা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কাজ করার দন্ডদান উদ্দেশ্য ছাড়া কাউকে হত্যা করল, সে যেন পৃথিবীর সকল মানুষকেই হত্যা করল। আর কেউ কারো প্রাণরক্ষা করলে সে যেন পৃথিবীর সকল মানুষের প্রাণ রক্ষা করল।[1] তাদের নিকট তো আমার রসূলগণ স্পষ্ট প্রমাণ এনেছিল, কিন্তু এর পরও অনেকে পৃথিবীতে সীমালংঘনকারীই রয়ে গেল।[2]’।
ইসলাম আমাদের এরকম শিক্ষাই দেয়। তবে আফসোস এই যে, হয়তো ঐ ছেলেগুলোর কাছে একথা কখনও পৌঁছেনি। তারা জানেও না, এরকম একটা জঘন্য অপরাধ করে তারা দু:খজনকভাবে মৃত্যুবরণ করল। ‘ধ্বংসের বদলে ধ্বংস’, এটা ইসলামী শিক্ষা কখনই হতে পারে না। যে মুসলিম ভাইবোনরা অত্যাচারের শিকার হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, তার প্রতিবাদ করুন ভদ্রভাবে। আর যদি দেখেন কোনো বিচার হচ্ছে না, তাহলে আল্লাহর উপর বিচারের ভার ছেড়ে দিন। আমরা যে বিচার করবো, তা হয় বেশি হয়ে যাবে নাহয় কম হবে। কিন্তু আল্লাহর বিচার হবে সবচেয়ে উপযুক্ত। মনের ভেতর এ বিশ্বাস রাখুন। কোরানও (সূরা আল-মায়েদা) সে কথাই বলছে,
لَئِنْ بَسَطْتَ إِلَيَّ يَدَكَ لِتَقْتُلَنِي مَا أَنَا بِبَاسِطٍ يَدِيَ إِلَيْكَ لِأَقْتُلَكَ ۖ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ رَبَّ الْعَالَمِينَ
(২৮) আমাকে হত্যা করার জন্য তুমি আমার প্রতি হাত তুললেও তোমাকে হত্যা করার জন্য আমি তোমার প্রতি হাত তুলব না, আমি তো বিশ্বজগতের প্রতিপালককে ভয় করি।’
শারমিন আকতার
নির্বাহী সম্পাদক
প্রতিক্ষণ ডট কম
=======