অনেক আগে আমি একবার কার্টুনে একটা আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছিলাম। তুরস্কের ‘নাসিরুদ্দীন হোজ্জা কার্টুন কন্টেস্ট’-এ আমার যে কার্টুনটা পুরস্কার পায় সেটা আমার মোটেও পছন্দ ছিল না। একটা লোক জঙ্গলে একটা ছোট সাপ দেখে ভয় পেয়ে লাফ দিয়ে একটা গাছে চেপে বসেছে কিন্তু ঐ গাছটাই একটা বড় সাপ- এই ছিল কার্টুন। কাজেই ওটা যখন পুরস্কার পেয়ে গেল আমি ভেতরে ভেতরে বেশ লজ্জিত বোধ করলাম। আম্মা আর আমার স্ত্রীকে ছাড়া কাউকে জানালাম না।
আমার মা সবসময়ই আমার কার্টুন আঁকা নিয়ে হতাশ। প্রায়ই তাকে বলতে শুনতাম ‘কি সব ব্যাকা-ত্যারা আঁকে! সোজা করে আঁকতে পারে না?’ সেই মা দেখলাম বেশ উত্তেজিত এবং সম্ভবত তিনিই খবরটা বড় ভাইকে ফোন করে জানালেন। আর কি আশ্চর্য সন্ধ্যায় দেখি বড় ভাই পল্লবীতে আমার বাসায় এসে হাজির। তার একটা সিলভার কালারের টয়োটা গাড়ি ছিল সেটা চালিয়ে নিজেই এসেছেন। হয়তো তখন ড্রাইভার ছিল না। তাকে দেশে কেউ খুব একটা গাড়ি চালাতে দেখেনি। তার গাড়ি চালানো নিয়ে একটা মজার ঘটনা আছে। এই চান্সে সেটা বলে ফেলা যায়।
আসরার মাসুদ নামে এক তরুণ লেখক আছেন। এখন অবশ্য লেখালেখি বাদ দিয়ে তিনি বড় প্রকাশক। তার কাছে শুনেছি গল্পটা। তিনি একবার খুব ভোরে দূরে কোথাও যাবেন; রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন বাসের জন্য। বাস-রিকশা, স্কুটার কিছুই পাচ্ছেন না। কি করা যায়? তখন সে বিদেশী কায়দায় হাত তুলে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে গাড়ি দাঁড় করানোর প্ল্যান করল। অবশ্য চেষ্টা করে দেখা গেল কোনো গাড়িই থামছে না। হঠাৎ একটা সিলভার কালারের গাড়ি থামল। আসরার দেখল ড্রাইভিং সিটে হুমায়ূন আহমেদ বসা। তখন নাকি সে ভয়ে ছুটে পালিয়েছিল!
এবার আগের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। বড় ভাই এসে কোন কার্টুনটা এঁকে পুরস্কার পেলাম সেটা দেখতে চাইলো। কন্টেস্টের উদ্যক্তারা অবশ্য পুরস্কারপ্রাপ্ত কার্টুনগুলো ছাপিয়ে একটা বুক লেট ছাপিয়েছিল। তাতে আমার আঁকা কার্টুনটাও ছিল। তাকে বের করে দেখালাম। সে গম্ভীর হয়ে বলল, ‘গুড কার্টুন।’ তারপর মানিব্যাগ থেকে ৫ হাজার টাকা বের করে দিল। আমি তো লজ্জায় মরি। কি দরকার ইত্যাদী ইত্যাদী। যাই হোক, সেই প্রথম কার্টুন আঁকাআঁকিতে বেশ গিয়ার পেলাম।
তাঁর জন্মদিন বা মৃত্যু দিন এলে অনেকেই অনেক কিছু জানতে চায় আমার কাছে। আসলে স্মৃতিতে অনেক কিছুই ঘুরে ফিরে আসে। কিন্তু লিখতে গেলেই মন খারাপ হয়, নস্টালজিক হয়ে উঠি।
মনে আছে, আমি একবার তবলা বাজানো শেখার প্ল্যান করলাম। ঘরে তবলা বায়া ছিল। আর তবলচি ওস্তাদ আমার এক বন্ধু। তার কাছে বিকালে তালিম নিয়ে এসে রাতে নিজের ঘরে দরজা লাগিয়ে বাজাই। বেশ আয়ত্বে চলে এসেছিল। হঠাৎ একদিন বড় ভাই এসে হাজির-
‘ভালোই তো বাজাস। আমাকে শেখা।’
আমি পড়লাম বিপদে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রির শিক্ষককে তবলা বাজানো শিখাবো?
কী আর করা! তে রে কেটে তাক দিয়ে শুরু করলাম। আমার চেয়ে দেখা গেল তার উৎসাহই বেশি। তার প্র্যাকটিসের ঠেলায় আমি আর তবলা বায়া হাতে পাই না। অবশ্য খুব বেশি দিন আর তার উৎসাহ থাকল না, আমারও না। তবে এটা তো ঠিক কিছুদিনের জন্য আমি হুমায়ূন আহমেদের তবলা শিক্ষক ছিলাম- এটাই বা কম কি!
তবে আমাদের ভাই-বোনদের শিক্ষক হিসেবে সে ছিল খুবই কঠিন মেজাজের। মাঝে মাঝেই তার পড়ার টেবিলে আমার আর আমার ইমিডিয়েট বড় বোন শিখুর ডাক পড়ত। মেঘস্বরে বলত ‘বই নিয়ে আয়।’ তখন সে অন্য মানুষ। আমরা দুরু দুরু বক্ষে বই নিয়ে হাজির হতাম। ইংরেজি অংক বিজ্ঞান কোনোটা বাদ যেত না। একে এক সবই ধরত। তারপর সে হতাশ হয়ে হুঙ্কার দিত-
‘কাগজে বড় বড় করে লেখ- আমাকে দিয়ে কিছু হবে না।’
আমরা দুই ভাইবোন আগ্রহের সঙ্গে বড় বড় করে লিখতাম-‘আমাকে দিয়ে কিছু হবে না।’
কারণ জানতাম এরপরই সে ছেড়ে দেবে আমাদের। কিন্তু তার আগে আরেকটি কাজ করতে হতো। তিনি বলতেন ‘এবার নিচে সাইন করে তোদের ঘরে টাঙিয়ে রাখ।’
আমরা যথেষ্ট আগ্রহের সঙ্গে সাইন করে ঘরে টানিয়ে রাখতাম।
এই কদিন আগে নুহাশ পল্লী গিয়েছিলাম কী একটা কাজে। ফিরে আসার সময় নুহাশের কয়েকজন পুরনো বয়স্ককর্মী আমাকে ঘিরে ধরল। ‘আপনি একদিন এসে রাত থাকেন।’
‘কেন?’
‘আপনার চেহারার সাথে স্যারের চেহারার এত মিল। আপনে থাকলে মনে হবে স্যার নুহাশ পল্লীতে আছেন।’
আমি বললাম, ‘কেন স্যার তো আপনাদের সঙ্গেই আছেন। তার প্রিয় লিচু বাগানেই আছেন।’
জাগতিক থাকা আর আধ্যাত্মিক থাকার পার্থক্য হয়ত তারা বুঝতে চান না। তাদের ম্লান মুখের সামনে দিয়ে গাড়িতে উঠে চলে আসতে আসতে হঠাৎ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। গাছের পাতায় বৃষ্টির শব্দ। দমকা বাতাস আর সোদা মাটির গন্ধে মনে হলো, হুমায়ূন আহমেদ এখানেই আছে। কিংবা তাকে যেন সঙ্গে করেই নিয়ে চলেছি আমার অন্য ভাইবোনদের কাছে, যাদের সঙ্গে একসময় কেটেছে আমার শৈশবের সোনালী দিনগুলো।
সূত্র: রাইজিং বিডি.কম