৫৭ ধারা বাতিলের দাবী যে কারণে

প্রকাশঃ আগস্ট ২৮, ২০১৫ সময়ঃ ১০:৪৫ পূর্বাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ২:৩৮ অপরাহ্ণ

আমীর খসরু

57 dharaবাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরে সংবিধান প্রণেতারা সংবিধানে মানুষের বাক-ব্যক্তি স্বাধীনতার বিষয়গুলোসহ সামগ্রিক মৌলিক অধিকারের যতোটুকু সম্ভব তা সযত্নে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। আর তা করা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের মৌলচেতনাজাত গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। এই বিষয়গুলো সন্নিবেশিত করা হয়েছিল এই কারণে যে, সংবিধান প্রণেতারা ভেবেছিলেন দেশটি গণতান্ত্রিক ভাবধারায় পরিচালিত হবে। কিন্তু স্বল্পকালেই সে পথ থেকে তৎকালীন সরকার দূরে সরতে থাকে এবং স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই জরুরি অবস্থা জারির বিধানসহ কতিপয় নিবর্তনমূলক আইন প্রবর্তন (২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩), বিশেষ ক্ষমতা আইন (ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪) জারি করা হয়। এছাড়াও ১৯৭৩ সালে প্রিন্টিং, প্রেস এন্ড পাবলিকেশন্স অধ্যাদেশ (২৮ আগস্ট ১৯৭৩) জারি করা হয়। অন্যান্য বিষয় বাদ দিলেও প্রেস এন্ড পাবলিকেশন্স অধ্যাদেশ এবং বিশেষ ক্ষমতা আইনের মাধ্যমে সংবাদমাধ্যম ও বাক-স্বাধীনতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশটির যাত্রার সূচনালগ্নেই। এরপরে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে হাতেগোনা কয়েকটি বাদে সব সংবাদপত্র বন্ধ করা, একদলীয় বাকশাল কায়েমসহ সামগ্রিকভাবে মানুষের অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়।

অথচ ১৯৭২’র সংবিধানের তৃতীয়ভাগে মৌলিক অধিকার সুরক্ষার বিষয়ে ৩৯ অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক-স্বাধীনতার প্রসঙ্গটি রয়েছে। সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, (১) ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হইল। (২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ – সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং (খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খান ১৯৬০ সালে প্রথম সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধে কালাকানুন জারি করেছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ তাদের দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তা বাতিল করে নতুন যে একটি অধ্যাদেশ অর্থাৎ প্রেস এন্ড পাবলিকেশন্স অধ্যাদেশ (২৮ আগস্ট ১৯৭৩) প্রণয়ন করে। কিন্তু এটি জারি করার পরে দেখা যায়, তা ছিল আসলে ১৯৬০-এরই কালাকানুনের এদিক-সেদিক অর্থাৎ আগের কালাকানুনেরই রূপান্তর মাত্র।

এভাবে স্বাধীনতার পর থেকে বেসামরিক এবং সামরিক সরকারগুলো নানাভাবে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা রোধ ও ক্ষুন্ন করা এবং বাক, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা কিভাবে নিশ্চিহ্ন করা যায় সে চিন্তায়ই রত ছিল এবং আছে। এসব কালাকানুনের বিরুদ্ধে সাংবাদিকসহ সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের সচেতন মানুষের প্রতিবাদ আগেও জারি ছিল এবং এখনো আছে। এরই কারণে কখনো কখনো কালাকানুনে কিছুটা অদল-বদল হয়েছে বটে, তবে তা অচিরেই প্রত্যাবর্তন করেছে আরও কঠিন রূপে।

এ কথাটি সত্য যে, যে সরকারই ক্ষমতায় এসেছে তারা ক্ষমতার বাইরে থাকার সময় ওসব কালাকানুনের সমালোচনা করেছে, কিন্তু ক্ষমতায় এসেই আগের কালাকানুন বহাল তো রেখেছেই, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা আরও কঠিন-কঠোর করা হয়েছে।

বর্তমান সরকারও এর ব্যতিক্রম নয়। তথ্য প্রযুক্তি আইন-২০০৬ পরিবর্তন-পরিবর্ধনের মাধ্যমে হৃষ্ট-পুষ্ট করে এখন তা অবাধে ব্যবহার করা হচ্ছে বাক, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, মৌলিক অধিকারকে ক্ষুণ্ন করার জন্য। তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারাটি মূল তথ্য প্রযুক্তি আইনে যুক্ত করা হয় ২০১৩ সালে। ৫৭ ধারায় বলা হয়, ইলেক্ট্রনিক ফরমে মিথ্যা, অশ্লীল অথবা মানহানিকর তথ্য প্রকাশ সংক্রান্ত অপরাধ ও উহার দণ্ড – ৫৭ (১) কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েব সাইটে বা অন্য কোন ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি প্রদান করা হয়, তাহা হইলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ। (২) কোন ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন অপরাধ করিলে তিনি [অনধিক চৌদ্দ বৎসর এবং অন্যূন সাত বৎসর কারাদণ্ডে] এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।

সমাজের বিভিন্ন পর্যায় থেকে এই ধারাটির অপব্যবহার ও অপপ্রয়োগ, যথেচ্ছ ব্যবহার এবং ভিন্নমতালম্বীদের যে কোনো পর্যায়ের হয়রানি করা যায় বলে অভিযোগ উঠেছে। ধারাটি বিশ্লেষণেও দেখা যায় যে, মিথ্যা, অশ্লীল, নীতিভ্রষ্ট, অসৎ কিংবা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ করার বিষয়টির মানদণ্ড কি এবং কোন কর্তৃপক্ষ যথাযথভাবে, সঠিক পন্থায় তা নির্ধারণ করবে? নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ করার কিংবা মানহানি ঘটানোর বা আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে, কি হবে না – তা আগাম যাচাই-বাছাই হবে কিভাবে? কোন কর্তৃপক্ষ কোন মাপকাঠিতে এটা নির্ধারণ করবে? রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে বলে একটি কথা ধারাটিতে বলা হয়েছে। এরই বা নির্ধারণী মানদণ্ড কি? এখানে একটি বিষয় বলা প্রয়োজন যে, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি সম্পূর্ণরূপে একটি ভিন্ন বিষয়। আবার ব্যক্তির ভাবমূর্তি অন্য বিষয়। এখানে কৌশলে রাষ্ট্র ও ব্যক্তিকে একাকার করে ফেলার মধ্যে একটি কৌশল রয়েছে – এ বিষয়টি খুব সূক্ষ্মভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে। পুরো আইনটিতে ব্যক্তির মনোজগতে প্রবেশ করার একটি বিষয় রয়েছে অর্থাৎ মানুষ কে কি ভাবছে বা ভাবতে পারে এমন আগাম চিন্তা করার একটি অবাধ অধিকার সরকারকে দেয়া হয়েছে। আইনটির ব্যবহারের কারণে মানুষের হৃদয়, মগজ ও মনোজগত পর্যন্ত সরকার হাত দিয়ে ফেলেছে।

নানাবিধভাবে তথ্য প্রযুক্তি আইনের এই ধারাটির ব্যাপক ও যথেচ্ছ অপব্যবহার হচ্ছে এমনটি দেখা যাচ্ছে। সাংবাদিক প্রবীর শিকদার এর সাম্প্রতিকতম উদাহরণ।

তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার অপব্যবহার এবং অপপ্রয়োগের সম্ভাবনা সম্পর্কে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, ফৌজদারী আইনে দৃশ্যমাণ কোনো ক্ষতি প্রতিরোধ বা এর শাস্তির বিধান রয়েছে। দৃশ্যমাণ ক্ষতিই এই আইনে বিচার্য। কিন্তু তথ্য প্রযুক্তি আইনে যে ক্ষতির কথা বলা হয়েছে তা দৃশ্যমাণ নয় অর্থাৎ মানসিক ক্ষতি। যেমন মানহানি, ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়া, অসৎ পথে পরিচালিত হওয়া এর কোনোটিই দৃশ্যমাণ ক্ষতি নয়। যেমন একটি কথায় কেউ মনে করতে পারে তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে, আরেকজন এতে ভিন্নমত প্রকাশ করে বলতে পারে, না ক্ষতি হয়নি। ফলে যে আইনটি আছে তার যত্রতত্র অপপ্রয়োগ ও অপব্যবহার করা সম্ভব। ড. শাহদীন মালিক বলেন, মানহানি, ভাবমূর্তি নষ্টসহ এসব বিষয়গুলো দু’শ বছর আগে দুনিয়ার অধিকাংশ দেশের ফৌজদারী আইন থেকে উঠে গেছে। দৃশ্যমাণ ক্ষতি নয় এমন ক্ষতির জন্য দেওয়ানী মামলা করা যেতে পারে আর্থিক ক্ষতিপূরণ চেয়ে। তিনি বলেন, যদি তথ্য প্রযুক্তি আইনের এই ধারাটির জন্য ৭ থেকে ১৪ বছর জেল খাটতে হয়, তাহলে বাক-স্বাধীনতা বলতে গেলে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। বিষয়টি দাড়াবে এমন যে, কোনো কবির কবিতারও সমালোচনা করা যাবে না। কারণ কবি মনে করতে পারেন তার মানহানি হয়েছে বা ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে কিংবা মানসিকভাবে তিনি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন। তিনি বলেন, মানসিক ক্ষতি বা আঘাতের বিষয়টি ১৩শ থেকে ১৯শ সাল পর্যন্ত ইউরোপে ফৌজদারী আইনে ছিল। ওই সব দেশে রাজার বা জমিদারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন বা মানহানি হয়েছে বলে লক্ষ লক্ষ মানুষকে আইনের অধীনে শাস্তি ও মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দেয়া হয়েছে। ওই আইনের অপপ্রয়োগের কারণেই সেখানকার ফৌজদারী আইন থেকে এসব বিষয়গুলো বাদ দেয়া হয়েছে যথেচ্ছ ও খেয়াল-খুশি মতো অপব্যবহার ঠেকাতে। এ থেকে পরিত্রানের একমাত্র পথ হচ্ছে ৫৭ ধারাটিকে বিলোপ করা। যদি তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রে কারো ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা মানহানি হয় তাহলে দেওয়ানী আইনে মামলার বিধান রাখা প্রয়োজন।

(আমাদের বুধবার)
প্রতিক্ষন/এডি/এনজে

এই লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজের। এখানে প্রতিক্ষণ ডট কমের কোন নিজস্ব বক্তব্য নেই

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G